২০২৩ ও ২০২৪ অর্থবছরে ৪ হাজার কোটি টাকার গম রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে, যার সবই নিম্নমানের এবং দামও বাজার মূল্য থেকে বেশি। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে ২০২২ সাল থেকে এ ১১ লাখ টন গম আমদানি করা হয়।
সাধন চন্দ্রের আগে খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন কামরুল ইসলাম। ২০১৫ সালে তাঁর সময় ব্রাজিল থেকে পোকা খাওয়া ও নিম্নমানের গম আমদানি হয়েছিল। এ নিয়ে অনেক সমালোচনার পর সরকার ওই বছর গমের প্রোটিনের সর্বনিম্ন মান বা বিনির্দেশ সাড়ে ১১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ করে। কিন্তু সাধন চন্দ্র মজুমদার খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২২ সালে আবারও ওই বিনির্দেশ কমিয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ করা হয়। অর্থাৎ নিম্নমানের গম আমদানির সুবিধা করে দেওয়া হয়। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ দুই ব্যবসায়ীর স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে।
পুষ্টিবিদদের মতে প্রোটিনের পরিমাণ সাড়ে ১১ শতাংশ হলে গমে আর্দ্রতা বেড়ে যায়। এতে গমের মধ্যে ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণু বাড়তে থাকে। এ ধরনের গম গুদামে রাখার পর তা এক বছরের মধ্যে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। এ গমের আটা খেলে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, ক্যানসারসহ নানান ধরনের রোগ হয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সংগ্রহ শাখার ২০২২ সালের ২০ মার্চের স্মারকপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মতামতের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে আমদানি করা গমে প্রোটিনের মাত্রা ১২ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। তখন এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিলেন দেশের পুষ্টিবিদেরা। এর আগে ২০১৫ সাল থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয় ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ গম আমদানি করছিল। পরে সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠজনদের সুবিধা দিতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গমের পুষ্টিগুণবিষয়ক সাধারণ নির্দেশনা অনুযায়ী, গমের প্রোটিনের মান ১২ থেকে ১৮ শতাংশ হতে হবে। এর চেয়ে কম পুষ্টিমানের গম বা আটার তৈরি খাবার খেলে নানান ধরনের অপুষ্টিজনিত সমস্যার ঝুঁকি তৈরি হয়।
গম আমদানির ক্ষেত্রে গত এপ্রিলে খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে গ্রেইন ফ্লাওয়ার ডিএমসিসির চুক্তি হয়। তাতে প্রতি টন গমের মূল্য ধরা হয় ২৮০ ডলার। ওই মাসে জাতিসংঘের এফএওর ‘মাসিক খাদ্যপণ্যের দর’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়ার প্রতি টন গমের মূল্য ছিল ২০২ ডলার। জাহাজ ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তা সর্বোচ্চ ২২০ ডলার হতে পারে। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তর ৬০ ডলার বেশি দিয়ে ওই গম প্রতি টন ২৮০ ডলারে কেনে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাধন চন্দ্র মজুমদার ২০১৯ সালে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি খাতে গম আমদানির একচেটিয়া দায়িত্ব পায় রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান প্রডিনটর্গ। সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) আমদানির ক্ষেত্রে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে জ্বালানি খাতের পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইলেকট্রিক গ্রুপ মধ্যস্বত্বভোগীর দায়িত্ব পায়। এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মিঞা সাত্তার আর তাঁর ভাই আমিরুজ্জামান সোহেল হলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ দুই ভাই সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারি গম কেনায় এ দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। জিটুজির মাধ্যমে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে এ ধরনের তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা নিয়ে বারবারই প্রশ্ন উঠেছে। এটা গণ খাতে কেনা আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়নি সাধনের নিয়ন্ত্রিত খাদ্য মন্ত্রণালয়।
শুধু সরকারি খাত নয়, সাধন চন্দ্র মজুমদারের আমলে বেসরকারি খাতে গম আমদানির ক্ষেত্রেও ওই দুই ভাইয়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অগ্রাধিকার পায়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে খাদ্য অধিদপ্তরের পরপর দুটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে প্রায় ১ লাখ টন গম আমদানির অনুমতি পায় এ দুই ভাইয়ের আরেকটি প্রতিষ্ঠান আর ডি গ্লোবাল।
আর ডি গ্লোবালের মালিকানাস্বত্বের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমিরুজ্জামান সোহেল ওই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মালিক। দুই ভাইয়ের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইলেকট্রিক গ্রুপের প্রধান কার্যালয় হিসেবে মহাখালী ডিওএইচএসের ২৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। আর ডি গ্লোবালের ক্ষেত্রেও একই ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানটি দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্রেইন ফ্লাওয়ার ডিএমসিসির বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে। এভাবেই নিম্নমানের গম উচ্চমূল্যে এনে সাধন অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। জানা গেছে, এসব টেন্ডারে সাধনের কমিশন ছিল ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
এ কমিশন পদ্ধতি সাধন চালু করেছিলেন তাঁর নির্বাচনি এলাকায়। রাস্তা উন্নয়ন, পাকাকরণ, সংস্কারসহ সব কাজেই ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হতো সাধন সিন্ডিকেটকে। ঘুষের কমিশনের টাকা কম হলেই রোষানলে পড়তেন ঠিকাদাররা। সর্বশেষ সড়ক বিভাগ সদর থেকে আত্রাই, বদলগাছী ও মহাদেবপুর এবং মান্দা থেকে নিয়ামতপুর উপজেলার ছয়টি সড়কে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকার কাজ শুরু করে। আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়নের এ প্রকল্প থেকে আগাম ২০ শতাংশ টাকা নিয়েছে সাধন সিন্ডিকেট। এ ছাড়া কমিশন নেওয়া অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে ভূমি অফিস, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন, মডেল মসজিদ স্থাপন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, হাসপাতাল বর্ধিতকরণ, থানা ও পুলিশ ব্যারাক সম্প্রসারণ প্রকল্প, জজ কোর্ট সম্প্রসারণ, টিটিসির একাডেমিক ভবন নির্মাণ, খাদ্য বিভাগের গুদাম নির্মাণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণসহ আরও ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ উল্লেখযোগ্য। এসব থেকেও কমিশন নিতেন সাধন।
স্থানীয়রা জানান, সাধন চন্দ্র মজুমদারের হুকুম ছাড়া কোনো নথি নড়ার সুযোগ ছিল না। সরকারি নির্মাণকাজ, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ছাড়াও নিয়োগ, স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি, জমি দখল, বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণসহ সবখানেই লাগত তাঁর অনুমোদন।
জেলার সব হাটবাজার নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিতেন সাধনের লোকজন। তাঁরাই নির্মাণ করেছেন নিম্নমানের দুর্যোগসহনীয় ঘর। এ ছাড়া জেলায় হাজার কোটি টাকার সিএসডি নির্মাণ প্রকল্প ও সাপাহারে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনায় সাধন সিন্ডিকেটের বড় ধরনের বাণিজ্য করার উদ্দেশ্য ছিল। সেখানে বেশির ভগ জমিরই বায়নাসূত্রে মালিক বনে গিয়েছিলেন সাধন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। কম মূল্যে জমি কিনে বেশি মূল্যে সরকারের কাছে বিক্রির ছক এঁকেছিলেন তাঁরা। তবে দেশের পট পরিবর্তনে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
২৫ কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা মামলায় সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পরে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ১৯ ডিসেম্বর সাধন চন্দ্র মজুমদারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ২৫ কোটি ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার তথ্যানুযায়ী, সাবেক এই খাদ্যমন্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ৪৩ কোটি ৪ লাখ ৪৭ হাজার ১৭৫ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে।