প্রকৃতির ঋতু বৈচিত্র্যে ভরা, নদী-খাল-বিল আর সবুজ শস্যক্ষেত্রের বুক জুড়ে বছরের প্রথম দিনে উদিত হয় এক নতুন সূর্য, যার আলোয় ঝলমল করে বাঙালির ঐতিহ্য, আশা আর সংস্কৃতির সোনালি রং। এই দিনটি আর পাঁচটি সাধারণ দিনের মতো নয়; এটি একটি আবেগ, একটি চেতনা, একটি আত্মপরিচয়ের দীপ্ত ঘূর্ণির নাম বাংলা নববর্ষ। গ্রীষ্মের আগমনে প্রকৃতি যখন খরখরে বাতাসে থমকে দাঁড়ায়, তখনই বাংলার আকাশে ভেসে আসে নতুন বছরের সম্ভাবনা। এটি সময়ের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ওঠে এসেছে হৃদয়ের উৎসবে, হয়ে উঠেছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
আজ যা এক আনন্দঘন, সংস্কৃতিময় এবং সর্বজনীন বাঙালি উৎসবে রূপ নিয়েছে, তার মূল শেকড় প্রোথিত ‘ফসলি সন’-এ। সময়ের সাথে সাথে এই ক্যালেন্ডার শুধুই একটি তারিখ গণনার পদ্ধতি থেকে সরে এসে হয়ে উঠেছে বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক বর্ণময় উৎসব। নববর্ষ মানে কেবল নতুন ক্যালেন্ডার নয়, নববর্ষ মানে পুরাতন ক্লান্তি, গ্লানি, দুঃখ আর সংকীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ। এই বৈশাখি ভোর, এই ভোরের আলোয় প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে জেগে ওঠে এক চিরন্তন ঐক্য যা ধর্ম, জাতি, বর্ণ, অঞ্চল বা শ্রেণি দিয়ে বিভক্ত নয়।
যেখানে হালখাতার হিসাব খোলার মিষ্টিমুখে একজন ব্যবসায়ী খুঁজে পান ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি, সেখানে একজন কৃষক এই দিনটিতে মনে মনে আশীর্বাদ করেন মাঠভরা ফসল উঠুক, সংসারে আসুক সচ্ছলতা। একদিকে চারুকলার রঙিন ক্যানভাসে আঁকা শোভাযাত্রা, অন্যদিকে গ্রামের মেলায় বাজতে থাকা ঢাকের শব্দ। সব মিলিয়ে এই নববর্ষ এক প্রাণবন্ত মিলনমেলা, যেখানে শহরের আর গ্রামের, ধনী-দরিদ্রের, মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলের হৃদয় এক সুতোয় বাঁধা পড়ে।
বাংলা নববর্ষ শুধু একটি দিন নয়, এটি বাঙালিত্বের মহোৎসব। এটি সেই দিন, যেদিন আমরা আমাদের শিকড়কে ছুঁয়ে দেখি। আমরা যে ভাষায় কথা বলি, যে গান গাঁই, যে খাবার খাই, যে পোশাক পরিধান করি, সবকিছুর মাঝে এই দিনটিতে আমরা খুঁজে পাই আমাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের উৎসব, যেখানে নজরুল আর রবীন্দ্রসংগীত থেকে শুরু করে লালনগীতি পর্যন্ত সব ধারা মিলে একসাথে বাঁধে সাংস্কৃতিক ঐক্যের মালা। এই দিনে আমরা ভুলে যাই বিভেদের সব দেয়াল। একটিমাত্র শুভেচ্ছা ‘শুভ নববর্ষ’ যা সকল ভাষা, মত ও ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের হৃদয়কে এক করে তোলে।
ঊনবিংশ শতক থেকে নববর্ষ হয়ে ওঠে বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অংশ। এটি শুধু প্রকৃতি বা ঋতুর গান নয়, বরং পুরোনো ক্লান্তিকে ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যমে বাঁচার ডাক। পরবর্তীকালে ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে নববর্ষ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। পাকিস্তানি শাসনামলে ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার অংশ হিসেবে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয় আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে। তখন থেকেই বাংলা নববর্ষ আর কেবল উৎসব নয়, হয়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এ সময়েই ছায়ানটের উদ্যোগে রমনা বটমূলে নববর্ষের সকাল বরণ করার প্রথা শুরু হয়, যা আজও চলমান।
ফসলি সনের খাজনা ভিত্তিক সূচনা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক জাগরণ, রাজনৈতিক প্রতিরোধ এবং সর্বশেষে এক সর্বজনীন আনন্দোৎসবে রূপান্তর বাংলা নববর্ষের এই যাত্রা একটি জাতির বিবর্তনের প্রামাণ্য দলিল। এটি যেমন অতীতের ঐতিহ্য বহন করে, তেমনি বর্তমানের চেতনায় জ্বলজ্বল করে এবং ভবিষ্যতের জন্য রেখে যায় এক দৃঢ় ভিত্তি।
নববর্ষ আমাদের শিক্ষা দেয় সহাবস্থানের, সহমর্মিতার এবং সংস্কৃতি-নির্ভর জাতীয় ঐক্যের। এই দিনে নেই কোনো ধর্মীয় বিভাজন, নেই কোনো রাজনীতির কলুষতা। ছোট বড় সবাই এই দিনে সমান আনন্দে মেতে ওঠে, যেন একটি জাতি একযোগে বলে ওঠে ‘আমরা বাঙালি, আমরা ঐক্যবদ্ধ।’ এটি এক জাতির ঐক্য সংলগ্ন প্রাণের উল্লাস, যার গভীরে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংগ্রামের গৌরবগাঁথা। বাংলা নববর্ষের এই ঐতিহ্য যতদিন বাঁচবে, ততদিন বাঁচবে বাঙালির আত্মপরিচয়, তার গর্ব, তার হৃদয়ের একতাবোধ।
এই নববর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা বিভক্তির নয়, মিলনের জাতি। আমাদের অস্তিত্বের মূলেই রয়েছে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আর ভালোবাসার এক অদৃশ্য বন্ধন। বাংলা নববর্ষ তাই শুধু সময়ের হিসাব নয়, এটি সময়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতির চেতনার উৎসব, আমাদের ঐক্যের সবচেয়ে সুন্দর প্রতিচ্ছবি।