দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীদের রিয়াল হিরো বলেছেন জাতীয় রাজম্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। একটি আনুষ্ঠানিকতায় এমন সম্বোধন সম্মানজনক, কিন্তু বাস্তবে কী দশায় এই হিরোরা? টিকে আছেন কিভাবে? বহু হিরো পুঁজি খুইয়ে ধার-দেনায় হাড্ডিসার, ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণে ভুগছেন। কিছু টিকে আছেন কোনো মতে। সামনের দিনগুলোতে কী হাল হবে, সেই চিন্তায় ঘুমহারা।
তাঁদের এ অবস্থার ফুল কোর্সটা করে গেছে বিগত পতিত সরকার। নিজে শেষ হওয়ার আগে, বাকিদের মেরে যাওয়া বা সর্বনাশ করার যাবতীয় কীর্তির অংশ হিসেবে হিরোদের জিরো বানিয়ে যাওয়ার প্রায় পুরো কাজই করে গেছে সরকার। রীতিমতো নিজের বাপের নাম ভুলিয়ে অন্যকে বাপ ডাকিয়ে ছাড়া হয়েছে তাঁদের। সব ব্যবসায়ী মনের সুখে সেখানে যাননি।
সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এবং বড় কর্তাদের দিয়ে ব্যবসায়ীদের ডেকে নিয়ে যা-তা বলানো হয়েছে। সরকারের বন্দনা গাওয়ানো হয়েছে। কথা বলানো হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোসাইরা এই অপকর্মটি করে দেশের প্রায় সব ব্যবসায়ীকে ভিলেনের জায়গায় নিয়ে গেছে।
নিজেরা গোষ্ঠীশুদ্ধ পালিয়ে বেঁচেছে, কিন্তু ব্যবসায়ীদের ফেলে গেছে অনিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে। সেই যাতনা সইছেন দেশের বিজনেস কমিউনিটির অনেকে।
দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে কোটি দশেক বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। তাদের মাত্র ১৫ লাখের মতো মানুষের চাকরিদাতা সরকার। বাকি চাকরি বেসরকারি খাতে।
এই বেসরকারিদেরই বিগত সরকার দলীয় বাহিনীর পর্যায়ভুক্ত করার হেন অপচেষ্টা নেই যা না করেছে। সরকারি অনুদান, দরপত্র এবং আমদানি-রপ্তানির সুবিধা প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে অনেক ব্যবসায়ীকেই আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এই যাতনায় ব্যবসায়ীদের অনেকে ধুঁকে ধুঁকে কেঁদেছেন। মুখ খুলে বলতেও পারেননি। প্রায় দেড় যুগ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অধীনে বিকলাঙ্গ করা ব্যবসায়ীদের এখন ভেতরে ভেতরে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ব্যথার কাতরানি সইতে হচ্ছে। তখন পারেননি, এখনো পারছেন না মনমতো কেঁদে বুকের কষ্ট কমাতে। রাষ্ট্রের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত করার যাতনা সইতে হচ্ছে গোটা দেশকেও। শীর্ষ পর্যায়ে মন্ত্রী, দলীয় নেতা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থার হোমরাচোমরাসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে দিয়ে রাজনৈতিক দখলদারি চালানোর জেরে কোনো না কোনোভাবে সব মানুষকে ভুগতে হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে থাকা ফৌজদারি তদন্তকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে যেভাবে প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীদের দমন করা হয়েছে, তা এ দেশে এক নতুন মাত্রার করপোরেট দাসত্বের জন্ম দিয়েছে। এর জের ও রেশ কত দিন সইতে হবে, কারো জানা নেই। এ ধরনের রাজনৈতিকীকরণ অর্থনীতিতে যে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে, তার উপশম দরকার। গবেষণা ও উদ্ভাবনের হার কমে গেছে। যেখানে পুঁজিপাট্টাতেই টান পড়ে গেছে, সেখানে কোনো ব্যবসায়ীই নিশ্চিত ভবিষ্যৎ না দেখে গবেষণায় বিনিয়োগ করেননি, করবেনও না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। তাঁরা দেখেছেন, রাজনৈতিক দলবাজি ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব। ব্যবসা খাতকে সেখান থেকে টেনে তুলতে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ দরকার। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণজাগরণ এবং তার পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারটি এখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। সেখান থেকে উত্রাতে রাজনৈতিক দখলদারির অবসান ঘটাতেই হবে। নিতে হবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ব্যবসা-বাণিজ্যে দলীয় পরিচয়কে গুরুত্ব না দিয়ে দক্ষতা ও স্বচ্ছতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। মাত্রা ও বাস্তবতা বিবেচনায় বিগত দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। স্বাধীন বিনিয়োগ পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। সুযোগের সদ্ব্যবহারে উগান্ডা-রুয়ান্ডা পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তাদের অনগ্রসর, দুর্ভিক্ষ-হানাহানির দেশের তালিকায় ফেলে রাখার দিন আর নেই। ইথিওপিয়াকে ট্রল করাও এখন অবিচার। মাত্র কদিন আগে ধসে পড়া শ্রীলঙ্কা তো ম্যাজিকের মতো বদলে গেছে। কোনো ঝাড়ফুঁক বা অলি-আউলিয়ার দোয়া বা আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়া নয়, খাদের কিনার থেকে যথাসময়ের যথাকাজ তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়েছে। অন্ধকার আফ্রিকা বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ ওখানে এখনো খাদক-মাদক-সিন্ডিকেট কম নয়।
পাশ্চাত্য নতজানু সমৃদ্ধ আফ্রিকাকে দরিদ্র করেছে তা দেশগুলোর নাগরিকদের বোধোদয়ে আসা হঠাৎ শুরু হয়নি। সময় লেগেছে। আন্তর্জাতিক উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি হওয়া শ্রীলঙ্কার পদক্ষেপগুলোর কথা ভাবা যায়। আফগানিস্তানের কিছু অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানো যায়। শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক দেউলিয়ার মুখোমুখি হওয়ার পরও মাত্র এক বছরের মধ্যে কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতি ফেরাতে সক্ষম হয়েছে। শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যপথে ব্যবসা-বিনিয়োগকে প্রায়োরিটি দিয়েছে। আস্থায় নিয়েছে বনেদি, পেশাদার বিজনেস হাউসগুলোকে। ব্যবসা-বিনিয়োগের পথে মসৃণতার গ্যারান্টি দিয়েছে। সামাজিক শক্তিকে দিয়েছে ভরসা। ফল মিলেছে ম্যাজিকের মতো। গতিময়তা পেয়েছে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি, অর্থনীতি, গণতন্ত্রসহ প্রায় সব নীতি ও তন্ত্রসহ শিরা-উপশিরা।
রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্য তৈরি, ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, তাঁদের রাজনৈতিক বিবেচনায় না নেওয়া, প্রবাসী রেমিট্যান্সের ব্যবহার, আন্তর্জাতিক ঋণ পুন আলোচনা এবং আমদানির ওপর কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের মূল অস্ত্র। আফগানিস্তান, তালেবান শাসন আসার পর আন্তর্জাতিক সহায়তা হারিয়েও স্থানীয় উৎপাদন, কৃষিকেন্দ্রিক অর্থনীতি এবং ধর্মীয় দান ব্যবস্থা ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছে অর্থনীতিতে। দুটি দেশেরই বিজনেস কমিউনিটিকে পজিটিভ কাজে লাগাতে পেরেছে সরকার।
রাষ্ট্র তার চরিত্রে পরিবর্তন আনলে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যকে মুক্ত ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে চাইলে বাংলাদেশেও তা সম্ভব। এখানে বর্তমান সরকার অরাজনৈতিক। আরোপ বা জবরদস্তি না করলে ব্যবসায়ীরাও আদতে অরাজনৈতিক। পুঁজির গ্যারান্টি ও হয়রানিমুক্ত পরিবেশ তাঁদের প্রথম এবং প্রধান চাওয়া। সেই গ্যারান্টি তো মিলছেই না, তার ওপর বৈশ্বিক বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা আরো কঠিনতর পরিস্থিতির মুখোমুখি। কর ও ভ্যাটের নিয়মিত পরিবর্তন, অগ্রিম আয়কর ও রেগুলেটরি ডিউটির অতিরিক্ত বোঝা, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা তাঁদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। হাড়ে হাড়ে ভুগছেন তাঁরা।
ব্যবসায়ীদের ঘেরাটোপে রাখা মানে ক্রেতা-ভোক্তাদের গহ্বরে ফেলা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজি শুনতে বলতে বড় মধুর। যে যত তথ্য-তত্ত্বই দিক তা অর্জন সরকারের একার পক্ষে অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। পরিবর্তিত পরিস্থিতি থেকেই যদ্দুর সম্ভব সেই সুযোগটা নিতে হবে। প্রথমত, ব্যবসায়ীদের আস্থা ও আয়ত্তে নেওয়ার বিষয় রয়েছে। আর ব্যবসায়ী বলতে দেশে কর্মসংস্থান ও সম্পদ সৃষ্টিতে যাঁরা যুক্ত। কিন্তু গণহারে ব্যবসায়ীদের শত্রু জ্ঞান করতে গিয়ে তাঁদেরও এক খাতায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এর অবসানে দরকার একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
ঋণখেলাপি গালমন্দে তাবৎ ব্যবসায়ীকে একাকার করে ফেলার হিল্লা করতে হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই। কে না জানে, কিছু ঋণ তো দেওয়াই হয়েছিল তা ফেরত না নেওয়ার জন্য। বকশিশ, স্পিড মানির নামাবলিতে ঘুষ সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ করেছে কারা? অর্থ পাচারকারীদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তার কথাও গোপন নেই। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সেসব বন্দোবস্তের লাগাম না টানলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঠিক হবে না। তা বুঝতে মস্ত অর্থনীতিবিদ হওয়া জরুরি নয়। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই বোধগম্য সরকারিভাবে ৫-৭ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। বাকিদের কর্মসংস্থানের ভরসা বেসরকারি সেক্টর। অথবা বিদেশ চলে যাওয়া।
বলা বাহুল্য, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের দাবিতেই গেল আন্দোলনের সূচনা, যা পরে গড়ায় সরকার পতনে। সরকারি চাকরির বাইরে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মোক্ষম কোরামিন হতে পারেন নোবেল লরিয়েট প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তাঁর ব্র্যান্ড ব্যবহার করে কেবল ঋণ-অনুদান বা অর্থ খাতে গতিময়তা নয়, দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের নয়া দরজা-জানালাও খুলতে পারে। আর হবে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভেদের বদলে আনতে হবে প্রতিযোগিতা। সেটার অনুঘটকও হতে পারেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন-উন্নতির কেচ্ছা শোনালেও দেশের অর্থনীতি হয়েছে অধোগতির শিকার। তার ওপর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে নানা কারণে সেখানে ধাক্কা যোগ হয়েছে। সাবোটাজ চলেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর। নানা প্রতিবন্ধকতা শেষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তোড়জোড়কে টেকসই করতে গেলে অর্থনীতির অন্যতম প্রাণশক্তি বেসরকারি খাতের শিরায় সঞ্চালন জরুরি। সেই উদ্যোগের প্রথমেই আবশ্যক ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। ব্যবসায়ী মহলকে এগিয়ে যাওয়ার গ্যারান্টি দেওয়া। তবেই রক্ত সঞ্চালন হবে অর্থনৈতিক সেক্টরে। আর বিনিয়োগ নিশ্চিত হলেই বাড়বে নিয়োগ।
গড়পড়তা হিসাবে দেশে বছরে ২৫ থেকে ২৭ লাখ কর্মক্ষম লোক চাকরিজীবনে প্রবেশের যোগ্য। যার ৫-৬ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরিতে অভিষেক হয় না। বাকিদের খুঁজতে হয় বেসরকারি দুয়ার। বিনিয়োগ না বাড়লে বেসরকারি চাকরির ব্যবস্থা হয় না, হবেও না। বিনিয়োগকারীরাই যদি পেরেশানিতে থাকেন, তাহলে চাকরিপ্রত্যাশীরা পেরেশান কেন, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার পিলারও পাবেন না। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের পর একটি আন্দোলনের মুখে সরকার এসেছে। এটা কোনো স্বাভাবিক সরকার নয়। এর পরও এ সরকারের কাছে নতুন অনেক প্রত্যাশা।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকলাঙ্গ দশা কাটানোর দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে। বেসরকারিদের ঘুরে দাঁড়াতে দেওয়ার সুযোগ তৈরির দায়িত্বও তার। অ্যাডহক নয়, টেকসই উন্নয়ন ছাড়া এ আঁধার কাটবে না। আর সেটা বাস্তবায়নে সরকার এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় অত্যাবশ্যক। বেসরকারি খাতের ভূমিকাকে কেবল স্বীকৃতি নয়, মর্যাদাও দিতে হবে। গেল সরকার তা আমলে না নিয়ে নোংরা রাজনৈতিকীকরণে ব্যবসায়ীদের অমর্যাদাই করেনি; ঝুঁকিতেও ফেলে গেছে।
এরও আগে, আরেক স্টাইলে ব্যবসায়ীদের অপদস্থ করেছে ওয়ান-ইলেভেন নামের আরেক ফ্যাসিবাদ। কথায় কথায় ব্যবসায়ীদের মন্দলোক সাজিয়েছে। করেছে চরম কলঙ্কিত। ব্যবসায়ীদের সেই ঘায়ের ব্যথা এখনো সারেনি। এক-এগারোর সেই ধকলের মাঝে গেল সরকার তাদের দিয়ে গেছে আরেক যাতনা। লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন