উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম মহিলা নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর স্মৃতিবিজড়িত লাকসাম পশ্চিমগাঁও নওয়াববাড়ি বহু প্রতীক্ষার পর জাদুঘরে রূপান্তরিত হলেও এর সম্পদ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালীরা জাদুঘরের জমি দখল করে নিচ্ছেন। হাতি ও ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী যে পথ দিয়ে বাড়ি আসা-যাওয়া করতেন তা এখন দখল করে নিয়েছেন এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। ইতোমধ্যে বাউন্ডারি দিয়ে পথটি বন্ধ করে দিয়েছেন।
লাকসাম পৌরসভার পক্ষ থেকে নবাব ফয়জুন্নেসা জাদুঘরের প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতা ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সৈয়দ আলী নামে প্রভাবশালী এক ব্যক্তিকে চূড়ান্ত নোটিস দেওয়া হলেও ‘রহস্যজনক’ কারণে গত ছয় মাসেও তা কার্যকর হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে, অভিযুক্ত সৈয়দ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে গেজেট ও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় লাকসামের পশ্চিমগাঁও নওয়াববাড়ি ও তৎসংলগ্ন ৪.৫৫ একর জায়গা প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু প্রভাবশালী অসাধু মহলের কারসাজিতে নওয়াববাড়ির অনেক মূল্যবান ঐতিহ্য ও স্থাপনা ধ্বংস ও বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
জীবদ্দশায় ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী তাঁর সম্পদ জনকল্যাণে ওয়াকফ করে যান। যাতে তাঁর উত্তরসূরিদের সম্পদ ব্যবহার ও ভোগ দখলের শর্ত থাকলেও বিক্রয় ও হস্তান্তর নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বহু আগে থেকেই একটি প্রভাবশালী চক্র নওয়াব পরিবারের দুই উত্তরসূরিকে ম্যানেজ করে নামমাত্র মূল্যে ওয়াকফকৃত বেশ কিছু জায়গা ভুয়া দলিলের মাধ্যমে কেনাবেচা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রায় আট বছর আগে এক প্রভাবশালী নওয়াব ফয়জুন্নেচ্ছা চৌধুরানীর বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথ বন্ধ করে বাড়ি নির্মাণকাজ শুরু করেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এতে আপত্তি জানালে উপজেলা প্রশাসন বাড়ির নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘদিন অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে নির্মাণাধীন বাড়িটি। এরপর তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর বাড়িকে জাদুঘরে রূপান্তরে উদ্যোগ নেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ২০২৩ সালের ২ জুন নওয়াব ফয়জুন্নেছার বাড়ি পরির্দশন করে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংস্কৃৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমেদের উপস্থিতিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মহাপরিচালক ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক লাকসাম পশ্চিমগাঁও নওয়াববাড়িতে জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠানিকভাবে নওয়াব ফয়জুন্নেছা জমিদারবাড়ি জাদুঘর হিসেবে উদ্বোধন করা হয়।
২০২৪ সালের ২৭ মে ঢাকায় জাদুঘর পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের প্রশাসক আবু সালেহ মহিউদ্দিন খাঁ ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন।
তবে শুধু বাড়িটিকে জাদুঘরের জন্য রেখে দিয়ে আশপাশের প্রত্নতত্ত্বের গেজেটভুক্ত চৌহদ্দির জায়গা ও ওয়াকফকৃত সম্পত্তি দখলের উৎসবে মেতে উঠেছেন প্রভাবশালীরা। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীরা জাদুঘরের জমি দখলের উদ্দেশ্যে ভূমি অফিস থেকে পশ্চিমগাঁও মৌজার আরএস খতিয়ানও উধাও করে ফেলেছেন। নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরী ফাউন্ডেশনের সভাপতি আজাদ সরকার লিটন জানান, নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর সব সম্পদ রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। কোনো প্রভাবশালী মহল যেন নওয়াববাড়ি জাদুঘরের এক ইঞ্চি সম্পদও দখল করতে না পারে, এজন্য আমরা তৎপর রয়েছি। এ বিষয়ে আমরা সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
লাকসাম উপজেলা তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল হাই সিদ্দিকী নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী জাদুঘরের আশপাশে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ কাজের জন্য সরঞ্জামাদি এনে স্তূপ করার অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেখানে সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেন।
লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে কাউছার হামিদ দায়িত্ব গ্রহণের পর বাড়িটির ঐতিহ্য রক্ষা ও ভূমিদস্যুদের কবলে থাকা সম্পদ উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যা সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আমিরুল কায়ছার বাড়িটি পরিদর্শনে গিয়ে অবৈধভাবে কেউ নওয়াববাড়ির জায়গা কিংবা গেট দখল করলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেন।