কুমিল্লা নগরীর ছাতিপট্টি এলাকার ব্যবসায়ী শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান। তিনি শখের বশে ৬২ বছর ধরে ধাতব মুদ্রা ও প্রাচীন সামগ্রী সংগ্রহ করে আসছেন। তার সংগ্রহে রয়েছে ৩০০ বছরের বিরল রুপার হুক্কা, যা তিনি দাবি করেন দেশে একমাত্র। এ ছাড়া রয়েছে ১১৬ বছরের পালং খাট, ২৫০ বছরের রুপার টাকা রাখার বাক্স, রুপার পানদানি, গহনার বাক্স, রুপার নৌকা, চেয়ার, সেতার, গলার হার, কাঁটা চামচ, গ্লাস, সুরমাদানি, আতরদানি, কুপি ইত্যাদি।
তার বাড়ি যেন এক প্রাচীন সামগ্রীর জাদুঘর। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কফি কালারের লোহা কাঠের নকশা করা খাটটি এখনো মজবুত। গত ৫০ বছরে একবার বার্নিশ করা হয়েছিল। এখনো এটি নতুনের মতো। প্রাচীন জিনিসপত্র দেখতে প্রায়ই মানুষ ভিড় করেন সেখানে। ৬৯ বছর বয়সের শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান জানান, পিতা আজম খান অলংকারের ব্যবসা করতেন। তাদের ব্যবসার বয়স ৭৯ বছর। শখ থেকে তিনি ধাতব মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করেন। পালং খাটের বয়স ১১৮ বছর। ১৯৬৭ সালে বাবা আজম খান ও ১৯৮৮ সালে মা তাহেরা বেগম মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পার এটি আর তেমন ব্যবহার হয় না। অনেকে এসেছেন এটি নিয়ে যেতে। এই খাটের কাছে আসলে মা-বাবার কথা মনে হয়। তাদের স্মৃতি ধরে রাখতে এটি যুগের পর যুগ সংরক্ষণ করছেন। তার সন্তানদেরও অনুরোধ করেছেন ধাতব মুদ্রা ও বিভিন্ন সামগ্রী যেন বিক্রি না করেন। শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান জানান, পালংক খাটটি তার বাবা পাকিস্তান আমলে মুরাদনগর এলাকার এক জমিদার থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে সংগ্রহ করেন। সঙ্গে আনেন একটি ড্রেসিং টেবিল ও আলমিরা। খাটটি শত বছর আগের মতোই নতুন। এখনো কোনো ঘুনে পোকায় ধরেনি। তিনি জানান, ছোট বেলায় বোন রোকেয়া বেগম কাজলসহ মা- বাবার সঙ্গে ঘুমিয়েছেন এই খাটে। তার জন্মের আগে এটি সংগ্রহ করা হয়। খাটের গায়ে খোদাই করে লেখা আছে ৮ কার্তিক ১৩১৭ বাংলা। এর কারিগর কৈলাস চন্দ্র সূত্রধর। তাদের বাড়িতে এটি আছে ৭৭ বছর ধরে।
এটি লম্বা ৮ ফুট। পাশে ৬ ফুট। খাটের স্ট্যান্ডসহ উচ্চতা সাড়ে ৭ ফুট। খাট ফ্লোর থেকে ২ ফুট উঁচুতে। এদিকে রুপার হুক্কাটি তিনি কুমিল্লা নবাব বাড়ি থেকে সংগ্রহ করেন। তিনি এই সংগ্রহ আরও বাড়াবেন বলে জানান।
আলমগীর খান জানান, এই সংগ্রহ শুধু শখ নয়, বরং তার পারিবারিক স্মৃতির অংশ। বিশেষ করে শতবর্ষী পালং খাট তাকে বাবা-মায়ের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ ৩০ দেশের দুই শতাধিক মুদ্রাও রয়েছে তার সংগ্রহে।
কুমিল্লা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল আবেদীন বলেন, ২৫০ বছরের ধাতব মুদ্রা, প্রাচীন রুপার পানদানি, টাকা রাখার বাক্স, গহনার বাক্সগুলো প্রমাণ করে এই এলাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা। এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।
সাংস্কৃতিক সংগঠক জামিল আহমেদ খন্দকার ও ডা. ইকবাল আনোয়ার বলেন, এসব ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী প্রমাণ দেয় কুমিল্লা ও তার আশপাশের এলাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার। আলমগীর খানের এই সংগ্রহ নতুন প্রজন্মকে তার এলাকার অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে সহযোগিতা করবে।
ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, কুমিল্লা ও তার আশপাশের এলাকা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। লোকজন শৌখিন ছিলেন। তার অংশ হিসেবে শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান ধাতব মুদ্রা সংগ্রহ করছেন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কুমিল্লা কার্যালয়ের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে সংরক্ষণে থাকা নিদর্শনগুলো দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তারা চাইলে এগুলো জাদুঘরেও সংরক্ষণ করতে পারেন।