ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজধানী ভোপাল শহরের এক হাসপাতালের বিছানায় বসে ছিল ১৫ বছর বয়সী আরিশ। ওর চোখের কালো চশমার পেছনে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বাঁ চোখের ক্ষতটা। আলোর উৎসব দিওয়ালি পালন করতে এমন এক নতুন ধরনের বাজি কিনেছিল, যেটা ওর মুখের কাছে ফেটে যায় সপ্তাহ খানেক আগে। আঘাত লেগে বাঁ চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে আরিশ।
জরুরি অপারেশন হয়েছে ওর চোখে, তবুও চিকিৎসকরা বলতে পারছেন না যে কতটা দৃষ্টি ফিরে পাবে ওই কিশোর। ও স্কুলে যায় না, কিন্তু ওর দুশ্চিন্তা হলো কাজে কী করে ফিরে যাবে। ওর বাবা মালির কাজ করেন আর পরিবারে কিছুটা অর্থ সাহায্য করতে আরিশ নিজে টেলিভিশন সারাই করে।
যদিও শিশু শ্রম ভারতে নিষিদ্ধ, তবুও লাখ লাখ অপ্রাপ্তবয়স্ক কাজ করে থাকে। ভারতের আইন অনুযায়ী, ১৪ বছর বয়স হলে ক্ষতিকারক নয় – এমন শিল্পে কাজ করার নিয়ম রয়েছে।
কয়েকশ’ শিশু-কিশোরের চোখে আঘাত
আরিশের মতোই উত্তর ভারতের অন্তত পাঁচটি রাজ্যের কয়েকশ’ শিশু-কিশোর দেওয়ালির সময়ে ওই নতুন ধরনের বাজি ফেটে চোখে আঘাত পেয়েছে। ‘কার্বাইড গান’ নামের এই নতুন বাজিটির কথা আগে কখনও শোনা যায়নি। দেওয়ালির কিছুদিন আগে থেকে সামাজিক মাধ্যমে ঘরে তৈরি এই বাজিটির ভিডিও সামনে আসে।
একটি সাধারণ প্লাস্টিকের পাইপের ভেতরে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ভরে দেওয়া হচ্ছে– তারপরই গুলির আওয়াজের মতো শব্দ, সঙ্গে আলোর ঝলকানি। তবে ঠিক কখন শব্দ হবে, তা অনিশ্চিত। অনেক সময়ে দেরিতেও ফাটছে এই ঘরোয়া বাজিটি। কেন বাজি ফাটছে না, সেটা দেখতে গিয়ে যখন বাচ্চারা পাইপের ভেতরে উঁকি দিচ্ছে– অনেক ক্ষেত্রে ঠিক সেই সময়েই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ক্যালসিয়াম কার্বাইড কেনা-বেচা ভারতে নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু কৃষক আর দোকানদাররা অনেক সময়েই কৃত্রিমভাবে ফল পাকানোর জন্য এই রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা আরও বলেছেন, চাষের খেত থেকে জন্তু-জানোয়ারদের ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্যও এ ধরনের ঘরোয়াভাবে তৈরি বন্দুক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে গত সপ্তাহে এত বেশি সংখ্যায় আহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্তও ভারতের বেশির ভাগ মানুষই এই ঘরোয়া বন্দুকের নামও শোনেননি।
হঠাৎ জনপ্রিয় এই বাজি
ঘরোয়াভাবে তৈরি এরকম যন্ত্র যে বাজি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়, সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরেই উত্তর ভারতে ব্যাপকভাবে বিক্রি হতে থাকে এই কার্বাইড গান।
মধ্য প্রদেশের শুধু ভোপাল জেলাতেই ‘কার্বাইড গান’ ফেটে একশরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ১৫ জনের চোখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। অন্য তিন জেলা থেকেও একশর বেশি ঘটনা সামনে এসেছে।
বিহারের রাজধানী পাটনার রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথালমোলজির প্রধান ড. বিভূতি প্রসন্ন সিনহা জানিয়েছেন, ওই রাজ্যে একই ধরনের বিস্ফোরণে ১৭০ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪০ জনের চোখে অপারেশন করতে হয়েছে। তবে তিনি বলছেন, অনেক ঘটনার কথা হয়ত তারা এখনও জানেন না, তাই আহতদের সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি।
ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড আর উত্তর প্রদেশ ছাড়া ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও একই ধরনের বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। মধ্য প্রদেশের মতো কয়েকটি রাজ্য এখন ওই ‘কার্বাইড গান’ বাজি হিসেবে ব্যবহারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, কয়েকজন বিক্রেতাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
ভোপালের হামিদিয়া হাসপাতালের চক্ষুরোগ বিভাগের প্রধান কভিথা কুমার বলছিলেন যে, তাদের কাছে যেসব রোগী আসছেন, তাদের মধ্যে হালকা, মাঝারি আর ব্যাপক আঘাত পেয়েছেন চোখে– সব ধরনের মানুষই আছেন।
তিনি বলেন, “যারা কম আঘাত পেয়ে আসছেন, তাদের মূলত চোখের পাতায় রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়ে হালকা জ্বলে গেছে। মাঝারি ধরনের আঘাত প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে রাসায়নিক কণা কর্ণিয়াতে ঢুকে গিয়ে মাঝারি ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করেছে। যাদের বেশি আঘাত, তাদের কর্ণিয়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সাময়িকভাবে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়েছে। অপারেশন করলে এ ধরনের রোগীদের দৃষ্টিশক্তি ফিরতেও পারে, তবে তাতে সময় লাগবে।”
আঘাতের ভয়াবহতা দেখে চমকে গেছেন বলে কয়েকজন চিকিৎসক জানিয়েছেন। ওই হামিদিয়া হাসপাতালেরই চিকিৎসক ড. অদিতি দুবে জানান, দেওয়ালির বাজি ফেটে রাসায়নিক আঘাত হয়েছে– এমনটা তিনি আগে কখনও দেখেননি, তাই ‘কার্বাইড গান’ নিয়ে তাকে খোঁজ খবর করতে হয়েছে চিকিৎসা করার আগে। সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/একেএ