ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের জন্য ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনে (বিআরটিএ) আবেদন করেন শামীম আহমেদ। সংস্থাটি থেকে বলা হয়েছিল- ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড পেয়ে যাবেন। কিন্তু আবেদনের আড়াই বছর পার হওয়ার পরও শামীম আহমেদকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড এখন পর্যন্ত দিতে পারেনি বিআরটিএ।
শুধু শামীম আহমেদই নন, বিআরটিএর ভোগান্তির তালিকায় লাখো গ্রাহক। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এমনিতেই সহজে পাওয়া যায় না ড্রাইভিং লাইসেন্স। পরীক্ষায় অকৃতকার্য করে অনৈতিকভাবে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক সব প্রক্রিয়া অনুসরণ ও পরীক্ষায় পাস করে অপেক্ষায় রয়েছে ৭ লাখ ৩ হাজার সেবাগ্রহীতা। কিন্তু হঠাৎ করে ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি ও সরবরাহ প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে চালকদের। পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। ই-লাইসেন্স দেখতে আগ্রহী নয় পুলিশ। ফলে মামলাও করছে তারা। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন চালকরা। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৯ জুলাই ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বিআরটিএ। চুক্তির দিন থেকে পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ২৪ লাখ কার্ড সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু সাড়ে তিন বছরে কার্ড সরবরাহ করেছে মাত্র ১৬ লাখের মতো। পরের দুই বছরে কার্ড সরবরাহ করেছে ১৬ লাখ। সব মিলিয়ে চুক্তির দিন থেকে ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ বছরে ৪০ লাখ কার্ড প্রিন্ট করে সরবরাহ করার কথা ছিল। এজন্য বিআরটিএর সঙ্গে চুক্তি হয় ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ২৮ লাখ কার্ড সরবরাহ করেছে। বাকি কার্ড সরবরাহের জন্য সময় আছে মাত্র এক মাস। যদিও এখন পর্যন্ত ৭ লক্ষাধিক নতুন আবেদন জমা পড়ে আছে। ফলে পুরোনো জট কমানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
কার্ড জট পড়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড আমদানি সংকটে পড়ে যায়। তারপরও মাঝেমধ্যে কিছু কার্ড নিয়ে এসে ছাপানো হয়েছে। এরপর ২০২৩-২৪ সালের দিকে ডলার সংকট। এ সংকটের কারণে এলসি খোলা সম্ভব হয়নি। এতেও আটকে যায় স্মার্ট কার্ড। এতে কার্ডের জট শুরু হয়। স্মার্ট কার্ড বিতরণী প্রতিষ্ঠান বলছে, এ বছরের শুরুতে সাড়ে ৩ লাখ কার্ড ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু বিআরটিএ সেগুলোকে প্রিন্ট করতে অনুমোদন দিচ্ছে না। তবে বিআরটিএ বলছে, কার্ডের মান খারাপ থাকায় সংস্থাটি প্রিন্টের জন্য অনুমোদন দিচ্ছে না। নতুন করে এমএসপির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদও বাড়াবে না। এ আগস্ট থেকে দেশীয় কোম্পানি বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে (বিএমটিএফ) স্মার্ট কার্ড প্রিন্টের জন্য অনুমোদন দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ জানা গেছে, গত মার্চ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড বিতরণ করছে না বিআরটিএ। এ কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে স্মার্ট কার্ডের জট। তবে ইমারজেন্সি ও বিদেশ গমনিচ্ছুকদের জন্য স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে টিকিট, ভিসাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে হয় সংস্থাটিকে। তবে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স না পেলেও যে কেউ চাইলে অস্থায়ী ভিত্তিতে একটা অনুমোদনপত্র দেওয়া হচ্ছে। যেটা কাছে থাকলে সব জায়গায় বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সের সুবিধা পাওয়া যাবে। মামলাও করতে পারবে না।
জানতে চাইলে এমএসপির এইচ আর ম্যানেজার আশরাফ উদ্দিন মোস্তফা বলেন, সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী আমরা কার্ড বিতরণ করতে পারিনি। কারণ ২০২৩-২৪ সালের দিকে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছিল। এ ছাড়া করোনার কারণেও সমস্যা হয়েছিল। সে কারণে আমরা তিন বছরে ২৪ লাখের জায়গায় ১৬ লাখ কার্ড বিতরণে সক্ষম হয়েছি। সর্বশেষ আমরা সাড়ে ৩ লাখ কার্ড এনেছি। কিন্তু বিআরটিএ প্রিন্টের জন্য অনুমোদন দিচ্ছে না।
এ বিষয়ে বিআরটিএ পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) সীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, এমএসপি আমাদের চাহিদা অনুযায়ী কার্ড সরবরাহ করতে পারেনি। সেজন্য সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও কিছু কার্ডের মান খারাপ থাকায় আমরা সেটা প্রিন্ট করতে দিইনি।
তিনি আরও বলেন, টাকাসহ সংশ্লিষ্ট কাজ শেষ করলে এক সপ্তাহের মধ্যে ই-লাইসেন্স ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। ই-লাইসেন্স থাকলে পুলিশ হয়রানি করার কথা নয়। তারপরও কেউ যদি হয় আমরা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্মার্ট কার্ডের সংখ্যা বাড়লেও নতুন কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর দ্রুতই সেটা প্রিন্টের ব্যবস্থা করবে। আমরা আশা করি আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে।