দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদ-এর অন্তর্বর্তী অনুমোদন অবিলম্বে বাতিলের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে সাময়িকভাবে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছেন, ‘নগদের অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন অবিলম্বে বাতিল করাই সমীচীন হবে।’ যদি সরকার নগদের কার্যক্রম চালু রাখতে চায়- নগদ যেহেতু একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, সেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নগদকে সোনালী ব্যাংক অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি হিসেবে পুনর্গঠন করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও নির্ধারিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যৌথভাবে এটি পরিচালনা করে পরবর্তী সময়ে একটি কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে হস্তান্তরের পথ তৈরি করতে পারে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, এটি নগদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমকে বড় আকারের বিনিয়োগের মাধ্যমে বিকশিত করতে সহায়ক হবে। ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি আইনি কাঠামোর যথাযথ পরিপালন ও পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এর আগে গত ১৮ মে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মোতাছিম বিল্লাহকে নগদের সিইও হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হয়। পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে- নগদকে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) নিবন্ধন গ্রহণ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীনে তিন মাসের মধ্যে একটি নতুন কোম্পানি গঠন, মেমোরেন্ডাম ও আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন প্রণয়ন, নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং সম্পদ ও দায় হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ।
জানা যায়, ২০১৯ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই চালু হয় ডাক বিভাগের নগদ। রাজনৈতিক চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের মার্চে ছয় মাসের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন দেয়, যা পরবর্তীতে ৯বার বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এই বছরের এপ্রিল মাসেই। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ২১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রশাসনিক দল নিয়োগ করে নগদে। পরবর্তীতে নগদের এক পরিচালক হাই কোর্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করেন। হাই কোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বহাল রাখলেও, আপিল বিভাগ গত ৭ মে আট সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ দেয়, যার ফলে ১২ মে থেকে প্রশাসকের কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। তখন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ মিশুক ই-মেইলের মাধ্যমে শাফায়েত আলমকে সিইও হিসেবে নিয়োগ দেন, যা পরিচালনা পর্ষদে পাস হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, এই দুই ব্যক্তি এখনো নগদের অর্থ ও আইটি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এবং সেখানে অবৈধ লেনদেন ও অনিয়ম চলমান রয়েছে। ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর জমা দেওয়া এক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, নগদ ৬৪৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ই-মানি ইস্যু করেছে যার বিপরীতে প্রকৃত টাকা ছিল না। এ ছাড়া ১৭১১ কোটি টাকা সরকারি ভাতা ৪১টি অবৈধ ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তানভীর আহমেদ মিশুকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ৬৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশঙ্কা করছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা নগদের মাধ্যমে ভাতা বিতরণ করতে অনিচ্ছুক হয়ে উঠছে। কারণ অতীতে এই মাধ্যমেই বড় আকারে আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। অথচ সরকারি ভাতা বিতরণই নগদের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানিয়েছে, ডাক বিভাগ এমএফএস পরিচালনার মতো কারিগরি ও পরিচালনাগত সক্ষমতা রাখে না। ২০১৮ সালের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিধান অনুযায়ী, শুধু তফসিলি ব্যাংকগুলো তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস চালাতে পারে, অর্থাৎ নগদের প্রাথমিক কাঠামোই ছিল বিধিমালার লঙ্ঘন।