তখনকার আরবে নারীদের ইজ্জত-সম্মান ছিল না বললেই চলে। দূষিত পরিবেশে একজন অবলা নারীর প্রতি তার এমন সম্মান প্রদর্শন এবং নিজেকে নিষ্পাপ রাখার এমন পরাকাষ্ঠা ইতিহাস এড়াতে পারেনি। একসময় সেই ঈমানদীপ্ত নারী বলতে বাধ্য হয়েছেন, তার মতো ভালো মানুষ আমি দেখিনি। চলুন, বিস্তারিত তাঁর মুখেই শুনি—
উম্মুল মুমেনিন উম্মে সালামা (রা.) বলেন, ‘আমার স্বামী আবু সালামা যখন নিজের জীবন ও ঈমান বাঁচাতে মদিনা হিজরত করেন, আমাকে আর আমার সন্তানকে আটকে রাখা হলো মক্কায়।
প্রায় এক বছর কেঁদেছি আমি স্বামী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। যে মুহূর্তে আমাকে বলা হলো, যা-ও তোমার স্বামীর কাছে, সন্তানকেও ফিরিয়ে দেওয়া হলো আমার কোলে, এক মুহূর্তও বিলম্ব করলাম না। একা একাই বেরিয়ে পড়লাম মদিনার পথে। এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ আমার সঙ্গে ছিল না।’
মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে তানঈম নামন স্থানে যখন পৌঁছালাম, সামনে পড়ল উসমান ইবনে তালহা। (তখনো তিনি মুশরিক) তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—কোথায় যাচ্ছ হে আবু উমাইয়্যার কন্যা?
আমি বললাম—যাচ্ছি মদিনায়। স্বামীর উদ্দেশে।
—তোমার সঙ্গে কি কেউ নেই?
—না, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই।
আর আছে আমার এই ছোট্ট সন্তান।
—আল্লাহর কসম! এভাবে একাকী তোমাকে যেতে দেওয়া যায় না। দাঁড়াও, আমি পৌঁছে দিচ্ছি তোমাকে মদিনায়।
অতঃপর তিনি আমার উটের লাগাম ধরলেন। আমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পথ চলতে শুরু করলেন।
আমরা যখনই কোনো মনজিলে (গন্তব্যে) যাত্রাবিরতি করতাম, তিনি আমার উটকে বসাতেন এবং দূরে সরে যেতেন। আমি নেমে দাঁড়ানোর পর ঠিকঠাক হলে তিনি কাছে এসে উটের পিঠ থেকে সামান নামাতেন। এরপর উটকে কোনো গাছের সঙ্গে বাঁধতেন। আমার থেকে দূরত্ব রেখে ভিন্ন একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে বিশ্রাম নিতেন। পুনরায় রওনার সময় হলে তিনি আমার উট প্রস্তুত করে আমার কাছে নিয়ে আসতেন। নিজে দূরে সরে গিয়ে বলতেন—উঠে পড়ো। আমি উঠে সোজা হয়ে বসার পর তিনি কাছে আসতেন। উটের লাগাম ধরে আবার যাত্রা করতেন।
প্রতিদিনই তিনি আমার সঙ্গে একই আচরণ করতেন মদিনা পৌঁছা পর্যন্ত। মদিনা থেকে দুই মাইল দূরে ‘কুবা’র নিকটবর্তী বনু আমর ইবনু আউফের বসতিতে পৌঁছার পর তিনি বললেন, তোমার স্বামী এই গ্রামেই আছেন। যাও তুমি, আল্লাহর নামে। অতঃপর তিনি সেখান থেকেই মক্কায় ফেরত যান।
তার এই নিষ্পাপ মার্জিত আচরণে মুগ্ধ উম্মে সালামা (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! তাঁর চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও সম্ভ্রান্ত কোনো আরবের সঙ্গ আমি পাইনি।’
উল্লেখ্য, উম্মে সালামা (রা.) ছিলেন আরবের সরদার-কন্যা। প্রাজ্ঞ ও বুদ্ধিমতী। বংশগত আভিজাত্যের পাশাপাশি বহুগুণে গুণান্বিত। মা আয়েশা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন উম্মে সালামাকে বিয়ে করলেন, তার রূপ সম্পর্কে শুনে আমি ভীষণ দুঃখ পেয়েছি। তাকে একনজর দেখার জন্য লালায়িত ছিলাম। যখন দেখলাম, লক্ষ করলাম যতটুকু বলা হয়েছে তিনি তার চেয়ে বহুগুণ বেশি রূপবতী।’ (তাবাকাতু ইবনে সাদ)
অন্যদিকে উসমান ইবনু তালহা (রা.) হুদাইবিয়ার সন্ধির পর ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর হাতেই আল্লাহর রাসুল (সা.) পবিত্র কাবা শরিফের চাবি হস্তান্তর করেন। পাশাপাশি এটাও বলেছেন, ‘চিরদিনের জন্য এ চাবি নাও। জালিম ছাড়া আর কেউ তোমাদের কাছ থেকে এ চাবি ছিনিয়ে নেওয়ার সাহস করবে না।’
ড. ইয়াসির কাদি বলেন, এই পবিত্রতম সফরটি মানসপটে চিত্রায়ণ করুন। উসমান ইবনে তালহা কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ দিন পুরো পথ হেঁটে উম্মে সালামাকে মদিনায় পৌঁছে দেন। অথচ তিনি ছিলেন অন্য গোত্রের। শুধু ভদ্রতার খাতিরে এমনটি করেছেন। অস্বস্তির মাত্রাটা লক্ষ করুন। একজন গায়রে মাহরামের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথ চলতে হয়েছে। তাঁরা ঘুমিয়েছেন দূরত্বে, কিন্তু তাঁদের অন্তত দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকতে হয়েছে। কারণ তখনকার পথ নিরাপদ ছিল না; চোর, ডাকাত ও হিংস্র পশুর আক্রমণের ভয় ছিল। উসমান ইবনে তালহা ১০-১২ দিন এক গায়রে মাহরাম নারীর সঙ্গে পথ চলেছেন, আর সেই নারী তাঁর আচরণ ও চরিত্রের সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে আমি আরবের মধ্যে উসমান অপেক্ষা অত্যধিক ভদ্র ও মহৎ ব্যক্তিকে দেখিনি। সুবহানাল্লাহ!
মহান আল্লাহ তাঁকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হেদায়েত দিয়ে ভূষিত করলেন। হিজরতের মর্যাদায় মহিমান্বিত করেন। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ও তাঁর বংশধরকে কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানিত করলেন পবিত্র কাবার চাবি বাহকের সম্মানে। এটা নিষ্পাপ যৌবনের অনন্ত পুরস্কার। ভালো মানুষের সঙ্গে আল্লাহ ভালোই করেন।