অনাচার, অসভ্য, অসত্যের নিকষ অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে প্রিয় নবী (সা.)-এর আবির্ভাব হলো মহা সত্যের চিরন্তন জ্যোতিষ্কের উদয়। তাঁর জন্মলগ্নে হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়। রোম সম্রাটের প্রাসাদে ফাটল ধরে এবং ১২টি চূড়া ধসে পড়ে। নওসেরা বাদশাহর সিংহাসন প্রচণ্ড গর্জনে নড়ে ওঠে ছয়টি পাথর ছিটকে পড়ে যায়।
একটি সাগর (মাওয়া দরিয়া) শুকিয়ে যায়, যা ছিল নরবলির কেন্দ্রস্থল। সামওয়া হ্রদ পানিতে ভরে ওঠে। কাবাঘরের রক্ষিত হুবল মূর্তি উপুড় হয়ে পড়ে আর অন্য প্রতিমাগুলোও কাঁপতে থাকে। এ সময় প্রকৃতি ছিল তাঁর আগমনপ্রত্যাশায় অধীর।
‘রবিউল আউয়াল’ অর্থ বসন্তের প্রারম্ভ। তাই মরুর ঊষর-ধূসর প্রান্তরে নবীর আগমন প্রতীক্ষায় প্রকৃতি সেজে ছিল মায়াবী রূপসজ্জায়, শোনা যায় আগমনী : সাহারাতে ফুটল রে রঙিন গুলে লালা
সেই ফুলেরই খোশ্বুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা
সে ফুল নিয়ে কারাকারি চাঁদ-সূরুয গ্রহ-তারা
ঝুঁকে পড়ে চুমে সে ফুল নীল গগণ নিরালা।
রবিউল আউয়াল প্রিয় নবী (সা.)-এর জন্মোৎসবে আহলাদিত গর্বের স্মারক চিহ্ন। প্রিয় নবী (সা.)-এর নামের মাহাত্ম্য এমন যে তিনিই একমাত্র অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যার নাম গর্ব ও শ্রদ্ধায় নিজের নামের সূচনায় মানুষ লিখে ‘মুহাম্মদ’ এবং নিজেকে ‘উম্মতে মুহম্মদি’ হিসেবে পরিচয় দেয়।
রবিউল আউয়াল খুশির মাস। প্রিয় নবী (সা.)-এর সম্মানে অবতীর্ণ আয়াতে আছে—‘বলুন (হে রাসুল) আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে তোমরা উল্লাস প্রকাশ করো।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৫৮)
ব্যাখ্যাকারীদের মতে, আয়াতে উদ্ধৃত মূল শব্দ ‘ফাদ্লুন’ অর্থ দয়া এবং ‘রাহ্মাত’ অর্থ অনুগ্রহ, শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যথাক্রমে—পবিত্র কোরআন ও প্রিয় নবী (সা.)-কে। এ জন্যই ভক্তির উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ প্রাণের উৎসব ও প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শ চর্চার শপথ গ্রহণের মাস রবিউল আউয়াল।
প্রিয় নবী (সা.) হলেন ‘রাহমাতুল-লিল আলামিন’।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্বের রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)
তাই তো ‘নবীপ্রেম’ একটি ঈমানি বিষয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনার আলোচনাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছি।’ (সুরা : ইনশিরাহ, আয়াত : ২)
এ পরিপ্রক্ষিতে সিরাতচর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘সিরাত’ অর্থ সুন্নাহ, মাজহাব, তরিকা, আকৃতি, অবস্থা, কীর্তি-কাহিনি, জীবনালেখ্য, যাওয়া, চলা ইত্যাদি। প্রায়োগিক দিক থেকে মূলত ‘সিরাত’ বলতে প্রিয় নবী (সা.)-এর জীবনচরিত বোঝায়। অন্যদিকে ‘সিরাতুন্নবী’ বলতে বোঝায়— (ক) ‘সিরাতে মাওলুদুন্নবী’ অর্থাৎ নবী (সা.)-এর জন্ম বৃত্তান্তমূলক আলোচনা। (খ) ‘সিরাতে হায়াতুন্নবী’ অর্থাৎ নবী (সা.)-এর যাপিত জীবনের বর্ণাঢ্য আলোচনা। (গ) ‘সিরাতে খুলুকুন্নবী’ অর্থাৎ নবীর (সা.) চরিত্র-আদর্শ শিক্ষামূলক আলোচনা।
‘সিরাতুন্নবী চর্চা’ কোনো নতুন বিষয় নয়। পবিত্র কোরআনেও মহানবী (সা.)-এর জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক সিরাতুন্নবী চর্চার প্রচলন মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর।
যেহেতু ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসেই প্রিয় নবী (সা.) তাঁর প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে গমন করেন; তাই প্রতিবছর এ মাস নবীপ্রেম ও আদর্শ চর্চার ডাক দিয়ে যায়।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ
কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর