দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির বদলে অভিবাসন নির্ভর নীতিতেই কানাডা আজ জনসংখ্যাগত সঙ্কটে। দেশটির জন্মহার গত চার দশক ধরে প্রতি নারী ১.৫ থেকে ১.৭ সন্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে ৩০ মিলিয়ন থেকে ৪১.২ মিলিয়নে—শুধুমাত্র অভিবাসনের কারণে।
লেখক জনাথন স্টিফেন হ্যারি রাইলি তাঁর বিশ্লেষণে বলেন, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২২শ শতকের শুরুতে কানাডার জনসংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি হবে। তবে সরকার এখন অভিবাসন কমানোর নীতিতে ফিরছে—যেখানে বার্ষিক অভিবাসীর সংখ্যা ৫ লাখ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে সাড়ে ২ লাখে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
রাইলির মতে, “অভিবাসীরা স্থানীয় সমাজে সম্পূর্ণভাবে মিশে যেতে সময় নেয়। আর কানাডিয়ানরা নিজেদের পরিচয় নিয়েই বিভ্রান্ত—কানাডিয়ান মানে কী, তা নির্ধারণে তারা ব্যর্থ।”
তিনি উল্লেখ করেন, গত চার দশকে নেতৃত্বের ধারাবাহিক পরিবর্তন দেশটির সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে দুর্বল করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কানাডাকে “প্রথম পোস্ট–ন্যাশনাল দেশ” বলে অভিহিত করেছিলেন—যা অনেকের কাছে জাতীয় চেতনা ধ্বংসের প্রতীক।
রাইলির মতে, পশ্চিমা সমাজে জাতীয়তাবাদকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ট্রমা ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির প্রভাবের কারণে। কিন্তু একই সময় ভারতের মতো দেশগুলো দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকেই স্বাধীনতার শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে।
তিনি লেখেন, “ভারত একসময় ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল, কিন্তু দেশপ্রেমই তাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। বিপরীতে কানাডিয়ানদের মধ্যে জাতীয় গর্বকে অনেকাংশে দমন করা হয়েছে।”
লেখাটি কানাডার অতীতেও দৃষ্টি দেয়—যেখানে ১৮১২ সালের যুদ্ধ (War of 1812)-এর সময় কানাডিয়ান ও ব্রিটিশরা যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছিল। রাইলির মতে, “এই ‘আমরা বনাম তারা’ মানসিকতা কানাডিয়ান পরিচয়ের সূচনা করেছিল, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।”
জন্মহার কমার পেছনের কারণ
রাইলি বিশ্লেষণ করেছেন, আধুনিক সমাজ নারীর প্রজনন-চক্রকে উপেক্ষা করে গড়ে উঠেছে। ক্যারিয়ার, উচ্চশিক্ষা ও অর্থনৈতিক চাপ নারীদের মাতৃত্ব বিলম্বিত করছে।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া মেডিকেল জার্নালের তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি জানান, কানাডায় প্রথমবার মাতৃত্ব গ্রহণের গড় বয়স এখন ৩২ বছর এক মাস।
রাইলির মতে, “অনেক নারী সন্তান নিতে চান, কিন্তু সময় চলে যায়—তখন আর সম্ভব হয় না।” তিনি ২০১৭ সালের দ্য গার্ডিয়ান–এর এক প্রতিবেদনের তথ্য দেন, যেখানে দেখা যায়, সন্তানহীন নারীদের ৯০ শতাংশই সন্তান চেয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র ৯ শতাংশের ছিল শারীরিক সমস্যা।
এছাড়া সমাজের ভোগবাদী সংস্কৃতি ও বিলাসী জীবনধারাও সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা কমাচ্ছে। নারী বা পুরুষ—উভয়ই জীবনের সাফল্যকে সন্তানহীন স্বাধীনতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন।
আধুনিকতার ফাঁদে মানুষ
রাইলি বলেন, “আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ভোগবাদ ও যৌন তৃপ্তিকে জীবনের সাফল্য মনে করা হয়। সন্তান নেওয়া মানে দায়িত্ব, ত্যাগ—যা আধুনিক সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত।”
তিনি ব্রিটিশ লেখক ও পডকাস্টার লুইস পেরির বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, “আধুনিক সংস্কৃতিতে মাতৃত্ব ও বয়োজ্যেষ্ঠ নারীর ভূমিকা অবমূল্যায়িত।” পেরি উদাহরণ দেন গায়িকা ম্যাডোনা ও কারদাশিয়ানদের, যারা “চিরযৌবনের প্রতীক” হিসেবে মাতৃত্ব এড়িয়ে চলেন—যা তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করছে।
রাইলি মনে করেন, “সন্তান জন্ম দেওয়া এখন কেবল জৈবিক নয়, নৈতিক সিদ্ধান্তও। কিন্তু অনেকেই নিজেদের স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করেন—এবং অনেক সময় তা চিরতরে হাতছাড়া হয়।”
সোর্স: মিডিয়াম
বিডি প্রতিদিন/আশিক