পবিত্র মক্কা ও মদিনার সঙ্গে মুসলমানের সম্পর্ক আবেগ ও ভালোবাসার। পবিত্র এই ভূমিতে নিজের স্মৃতিস্মারক রেখে যেতে চায় তারা। যুগে যুগে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মুসলিমরা এখানে ধর্মীয় নানা স্থাপত্য ও স্থাপনা গড়ে তুলেছে। তেমনি একজন বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ। তিনি মক্কা ও মদিনায় পৃথক দুটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ ছিলেন একজন জ্ঞানানুরাগী ও কবি। তিনি ফারসি ও আরবি ভাষায় কবিতা লিখতেন। পারস্যের কবি হাফিজের সঙ্গে তিনি পত্রালাপ করেন। কবি হাফিজের কাছে তিনি স্বরচিত কবিতা লিখে পাঠান এবং হাফিজকে বাংলা অঞ্চলে আমন্ত্রণ জানান। উত্তরে হাফিজ তাঁকে একটি গজল লিখে পাঠান। সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের আমলে বাংলা ভাষার প্রভূত উন্নতি হয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহম্মদ সগীর ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্য রচনা করেন এবং কৃত্তিবাস রামায়ণের বাংলা করেন।
সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ ১৩৮৯ থেকে ১৪১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। তিনি তাঁর শাসনামলে একাধিকবার মক্কা ও মদিনার অধিবাসীদের জন্য উপহার পাঠান। ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর প্রতিনিধি ইয়াকুত গিয়াসিকে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ মক্কার শাসকের কাছে পাঠান। সেখানে তিনি মক্কায় ভূমি ক্রয় ও মাদরাসা নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। শাসকের অনুমতি পেয়ে ইয়াকুত গিয়াসি মসজিদুল হারামের বাবে উম্মে হানির কাছেই দুটি বাড়ি কেনেন।
বাড়ি দুটিতেই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি মক্কার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী সাইয়েদ হাসান আজলানের কাছ থেকে দুটি বাগান কিনে মাদরাসার জন্য ওয়াক্ফ করে দেন। বাগান দুটি কেনা হয়েছিল ১২ হাজার মিসকাল স্বর্ণ দিয়ে। মাদরাসার জন্য ৫০০ মিসকাল স্বর্ণ দিয়ে একটি বাড়ি কিনে তা ওয়াক্ফ করা হয়েছিল। ৮১৪ হিজরির জমাদাল উলা মাসে মাদরাসার নির্মাণকাজ শেষ হয়। ৮৯৪ হিজরিতে মাদরাসার ভবন সংস্কার করা হয়।
মক্কার মাদরাসায়ে গিয়াসিয়্যাতে চার মাজহাব অনুসারে পাঠদান করা হতো। এতে পাঠদান করতেন মক্কায় কর্মরত চার মাজহাবের চার বিচারক। তাঁরা হলেন, জামালুদ্দিন মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ শাফেয়ি, শিহাবুদ্দিন আহমদ বিন জিয়া হিন্দি হানাফি, তাকিউদ্দিন মুহাম্মদ বিন আহমদ ফাসি মালেকি ও সিরাজুদ্দিন আবদুল লতিফ বিন আবুল ফাতাহ ফাসি হাম্বলি।
মাদরাসার জন্য ওয়াক্ফকৃত সম্পদের আয় পাঁচটি খাতে ব্যয় করা হতো। এক ভাগ চারজন শিক্ষকের জন্য ব্যয় করা হতো। তিন ভাগ মাদরাসার ছাত্রদের জন্য ব্যয় করা হতো। যাদের সংখ্যা ছিল ৬০। ২০ জন শাফেয়ি, ২০ জন হানাফি, ১০ জন মালেকি ও ১০ জন হাম্বলি। এক ভাগ মাদরাসার ১০ আবাসিক শিক্ষার্থী ও কর্মীদের জন্য ব্যয় করা হতো এবং এক ভাগ উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ব্যয় করা হতো। যেমন ভবন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, পানি সরবারহ, জ্বালানি সংগ্রহ ইত্যাদি। ইমাম সাখাভি (রহ.) তাঁর ওয়াজিজুল কালাম বইয়ে মাদরাসায়ে গিয়াসিয়্যার প্রশংসা করেছেন।
মাদরাসায়ে গিয়াসিয়্যাতে বহু খ্যাতিমান আলেম শিক্ষকতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন আবদুল ওয়াহাব তাজুদ্দিন বিন জাহিরাহ, আবদুল কাদির বিন মুহাম্মদ ফাসি মক্কি হাম্বলি, মুহাম্মদ জালাল আবু সাআদাত বিন জাহিরাহ। আর এই মাদরাসার বিখ্যাত একজন শিক্ষার্থী হলেন মুহাম্মদ বিন আবদুল করিম বিন মুহাম্মদ। তিনি মাদরাসার শাফেয়ি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। অন্য একজন বিখ্যাত ছাত্র হলেন আলী বিন আহমদ মারদিনি।
সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় মদিনায়ও একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি তাঁর সভাসদ হাজি ইকবাল ও মাওলা খানজাহানকে মদিনাবাসীর জন্য উপহারসামগ্রী দিয়ে পাঠান। তিনি মদিনার তৎকালীন শাসক জুমাজ বিন মানসুরের জন্যও উপহারসামগ্রী পাঠান। সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ হাজি ইকবালকে মদিনায় তাঁর নামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা এবং মাদরাসা পরিচালনার জন্য ওয়াক্ফ সম্পত্তি কেনার নির্দেশ দেন। হাজি ইকবাল মসজিদে নববীর বাবুস সালামের কাছে একটি প্রাচীন দুর্গ কিনে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
এ ছাড়া সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ হজযাত্রীদের সব ধরনের সাহায্য করতেন। তিনি একাধিকবার মক্কা ও মদিনা শহরের অধিবাসীদের জন্য প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। তিনি আরাফা ময়দানে পানি সরবরাহের নালা সংস্কারের জন্য ৩০ হাজার মিসকাল স্বর্ণ প্রেরণ করেন।
তথ্য সূত্র : আল ইকদুস সামিন, তুহফাতুল লাতিফা ও বাংলা পিডিয়া।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ