সফরে মানুষের ওপর সহযাত্রীদের নানা রকম প্রভাব থাকে, বিশেষ করে ইবাদত-বন্দেগি, আল্লাহমুখী হয়ে থাকা, হজের সফরে প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান জ্ঞান করা অথবা অবহেলা, উদাসীনতা, পরনিন্দা, সমালোচনা ও গালগল্পে সময় কাটানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযাত্রীদের ভূমিকা থাকে। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হুঁশিয়ারি হলো, ‘মানুষ তার বন্ধুর (সহকর্মী ও সহযাত্রীর) রীতি-নীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৩৩)
সহযাত্রী নির্বাচনে চাই সতর্কতা
হজের সফর একদিকে যেমন দীর্ঘ ও কষ্টকর, অন্যদিকে মুমিনের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এই সফর স্বপ্নের, সাধনার ও পরকালীন মুক্তি লাভের। ফলে হজের সফরে সহযাত্রী নির্বাচনে চাই অত্যন্ত সতর্কতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি মুমিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন আল্লাহভীরু লোকে খায়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৩২)
সহযাত্রী যেমন হওয়া উত্তম
হজের সফরে এমন ব্যক্তিকেই সহযাত্রী হিসেবে বেছে নিতে হবে, যে আল্লাহভীরু, আল্লাহমুখী, ইবাদত-বন্দেগিতে আগ্রহী, যে অহেতুক গল্প-গুজবে অভ্যস্ত নয় এবং সহনশীল ও সহযাত্রীদের সহযোগিতা করার মানসিকতা পোষণ করে।
হজযাত্রী যদি নিজে আলেম না হন, তবে হজের সফরে কোনো আলেমের সঙ্গী হওয়া উত্তম। এতে বিধানগত ভুলভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।’
(সুরা : তাওবা, আয়াত : ১১৯)
ইমাম তাবারি (রহ.) ‘সত্যবাদী’র ব্যাখ্যায় বলেছেন, যারা তাদের ঈমানের দাবিতে সত্য, যাদের কথা ও কাজের মধ্যে মিল আছে এবং যাদের ভেতর কপটতা নেই।
সহযাত্রীর সঙ্গে আচরণ যেমন হবে
হজের সফরে প্রত্যেকের উচিত তার সহযাত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা। পরস্পরকে দ্বিনি ও জাগতিক বিষয়ে সহযোগিতা করা। এ বিষয়ে কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা তুলে ধরা হলো—
১. হাসিমুখে সহ্য করা : ইসলামের শিক্ষা হলো সহযাত্রী পুরোপুরি মনঃপূত না হলেও তাঁর সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৫৬)
২. ভারসাম্য রক্ষা করে চলা : হজের সফরে সহযাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি, বিশেষ করে কারো সঙ্গে অতি বন্ধুত্ব বা অতি দূরত্ব যেন তৈরি না হয় সে দিকে লক্ষ রাখা।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘নিজের বন্ধুর সঙ্গে ভালোবাসার আধিক্য প্রদর্শন করবে না। হয়তো সে একদিন তোমার শত্রু হয়ে যাবে। তোমার শত্রুর সঙ্গেও শত্রুতার চরম সীমা প্রদর্শন করবে না। হয়তো সে একদিন তোমার বন্ধু হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৯৭)
৩. অগ্রাধিকার দেওয়া : হজের সফরে প্রত্যেকেই সহযাত্রীর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করবে। জাগতিক বিচারে কেউ পিছিয়ে থাকলেও আল্লাহর ঘরের মেহমান হিসেবে সবাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। তাই খাবার গ্রহণ, পরিবহনে আরোহণ ও তাঁবুতে অবস্থানের সময় প্রত্যেকেই নিজের সহযাত্রীকে অগ্রাধিকার দেবে। বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বৈঠকে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সবাই নিজেকে সবচেয়ে সম্মানী মনে করত।’ (মুখতারাত : ২/১৫)
৪. পরচর্চা পরিহার করা : হজের সফরে পরচর্চা অনেক সময় পুরো কাফেলার পরিবেশ ও হৃদ্যতা নষ্টের কারণ হয়। পরচর্চার মাধ্যমে ব্যক্তি মূলত নিজের আমলই ধ্বংস করে। তাই পরচর্চা পুরোপুরি বর্জন করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ কোরো না এবং পরস্পর গিবত কোরো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তা ঘৃণাই করে থাকো। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)
৫. পরস্পরকে সহযোগিতা করা : হজের সফরে সহযাত্রীর সেবা ও সহযোগিতাকে সৌভাগ্য লাভের মাধ্যম মনে করবে। কেননা এমন সুযোগ জীবনে নাও আসতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘সৎকর্ম ও আল্লাহভীতিতে তোমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে।’
(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২)
৬. অন্যের দোষ প্রচার না করা : সহযাত্রীদের ভেতর সবার জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, লেখাপড়া ও বিবেচনা সমান নয়, তাই হজের সফরে কারো থেকে কোনো ভুলত্রুটি প্রকাশ পেলে তা প্রচার না করে গোপন করাই উত্তম। এতে বহু ফিতনা থেকে বেঁচে থাকা যায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোনো মুসলমানের দোষত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৩০)
৭. আড্ডা পরিহার করা : হজের সফরের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান। তাই সব আড্ডা ও গল্পগুজব পরিহার করা আবশ্যক। এমনকি কারো সঙ্গে বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে উঠলেও আড্ডায় মত্ত হওয়া উচিত নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘লজ্জা-সম্ভ্রম ও অল্প কথা বলা ঈমানের দুটি শাখা। অশ্লীলতা ও বাকপটুতা (বাচালতা) নিফাকের দুটি শাখা।’
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০২৭)
একাকী চলবে না
প্রাজ্ঞ আলেম ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা হজের সফরে একাকী চলাফেরা করতে নিষেধ করেন। কেননা এতে নানা ধরনের বিপদ ও বিপত্তির আশঙ্কা থাকে। হজের সফরে যেহেতু অজানা ও অচেনা পরিবেশে যায়, তাই একাকী চলাফেরা করা আরো বেশি অনুচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) একাকী চলাফেরা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি লোকেরা একা সফরে কী ক্ষতি আছে তা জানত, যা আমি জানি, তবে কোনো আরোহী রাতে একাকী সফর করত না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৯৯৮)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন