মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে দেশের নানা স্থানে রয়েছে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণামূলক বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী হিসেবে আলবদর-রাজাকার লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে। এ গণহত্যার স্মারক হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয় এই ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটির অবস্থান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করে হাতের বামে। এটি শান্ত চত্বরের কোলঘেঁষে। ‘একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ নামক ভাস্কর্যটি গণহত্যার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাম্পাসে। এটি তৈরি করেছেন খ্যাতনামা শিল্পী ভাস্কর রাসা।
জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষকে ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভিতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হতো। এরপর লাশের স্তূপ সাজিয়ে গণকবর দেওয়া হতো এখানে। পরে সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মারক হিসেবে গণকবরের ওপরে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৮ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৯১ সালে। ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান এটি উদ্বোধন করেন। গুচ্ছ ভাস্কর্যটি দুটি অংশে বিভক্ত। এক অংশে রয়েছে সাধারণ মানুষের অংশ নেওয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি অপর অংশে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র। ভাস্কর্যটির নিচে রয়েছে পানি। যা দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশকে বোঝানো হয়েছে। অপরদিকে পানির ভিতরে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা। যা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বোঝানো হয়েছে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সফলতায় বাংলার মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার ভাবনা আসে। ভাস্কর্যটির যে অংশে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সেখানে বেদনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২৫ মার্চের কালরাতকে। এ অংশে দেখানো হয়েছে ওই রাতে ইয়াহিয়া খান মাতাল অবস্থায় আছেন এবং পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। একদিকে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে অত্যাচার করে হত্যা করা হচ্ছে অন্যদিকে লাশ ফেলে রাখা হচ্ছে যেখানে-সেখানে। ভাস্কর্যটিতে আরও রয়েছে একটি পত্রশূন্য বৃক্ষ। তার ওপর একটি শকুন বসে আছে। যা মুক্তিযুদ্ধের নির্মম গণহত্যার তৎকালীন বাংলাদেশের প্রতীক। অন্যদিকে অপর অংশে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির চিত্র। বাংলার কামার, কুমার, জেলে, কৃষিজীবী মানুষ দা, বঁটি, খুন্তি, বর্শা নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে মুখিয়ে আছে। ভাস্কর্যটির উল্টো দিকে দেখা যায়, সবাই আধুনিক অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ভাস্কর্যের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন প্রশিক্ষণ নেওয়া সাহসী এক কৃষকের ছেলে। তার চোখে যুদ্ধজয়ের নেশা। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবার চোখে প্রতিশোধ স্পৃহার ছাপ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে এটি এক প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের প্রতিটি ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা যে কোনো সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ-মিছিল, প্রতিবাদী বক্তব্য কিংবা বিভিন্ন সময়ে সাংস্কৃতিক আয়োজনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছে ভাস্কর্যটি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীর পাশাপাশি চলমান সব শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের গান, গল্প, আড্ডা, সুখ-দুঃখের খোরাক জমানোর স্থান হিসেবে এটি জনপ্রিয়। বিশেষ করে ভাস্কর্যটির রাত্রিকালীন রংবেরঙের আলোকসজ্জা, সৌন্দর্য মুগ্ধ করে তুলবে যে কোনো কাউকে। যদিও বর্তমানে ভাস্কর্যটি অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকে বেশির ভাগ সময়। বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়া এই ভাস্কর্যটির কোনো যত্ন নেওয়া হয় না। শুধু ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ও ভর্তি পরীক্ষার সময়ে ভাস্কর্যটিকে রংতুলির পাশাপাশি আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। অন্যান্য সময়ে অযত্ন, অবহেলায় পড়ে থাকে ভাস্কর্যটি।