জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (জাকসু) ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। গতকাল শেষ হয়েছে প্রার্থীদের প্রচারণার নির্ধারিত সময়। ভোট আদায়ে শিক্ষার্থীদের কাছে নানান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রার্থীরা। তবে নির্বাচন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাদক ও টাকার ছড়াছড়ি চলছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ছাত্রদের হলগুলোতে নিয়মিতই বসছে মাদকের আড্ডা। পাশাপাশি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ভোটারদের মাঝে বিরিয়ানি বিতরণের অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে জাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে অমর্ত্য রায়কে অংশ নেওয়ার অনুমতি দিতে হাই কোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত করেছেন চেম্বার জজ আদালত। এ ছাড়া নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে গতকাল প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট করেছে প্রশাসন। ডোপ টেস্টের প্রক্রিয়া নিয়ে চলছে নানান সমালোচনা।
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর আগামীকাল ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন ঘিয়ে প্রায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ১১টি হল এবং ছাত্রীদের ১০টি হলে ভোটগ্রহণ করা হবে। এরই মাঝে হলগুলোতে ২২৪টি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনায় প্রতিটি হলে একজন করে রিটার্নিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের অধীনে পুলিং অফিসার হিসেবে থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৭ জন শিক্ষক। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা সহকারী পুলিং অফিসার হিসেবে কাজ করবেন। নির্বাচনে সুশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ১ হাজার ২০০ পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকবে।
এদিকে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ক্যাম্পাসজুড়ে ততই বাড়ছে মাদকের ছড়াছড়ি। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা দিয়েছে তীব্র উদ্বেগ। অভিযোগ উঠেছে, অনেক প্রার্থীই প্রচারণার পাশাপাশি ভোটারদের হাতে মাদক পৌঁছে দিচ্ছেন। জানা যায়, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আড্ডাস্থল, বিশেষ করে টারজান পয়েন্ট, সিডনি ফিল্ড ও ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে মাদকের সহজলভ্যতা বেড়েছে। জুনিয়র শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে মাদক ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের সময় ভোটারদের প্রভাবিত করতে কিছু প্রার্থী গোপনে মদ-গাঁজাসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য সরবরাহ করছেন বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মওলানা ভাসানী হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, জাকসু নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসে মাদকের প্রভাব বেড়েছে। ছাত্রদের হলগুলোতে রাত বাড়লেই বসে মাদকের আসর। ভাসানী হল, সালাম-বরকত হল, আল-বেরুনী হলসহ ছাত্রদের প্রায় প্রতিটি হলেই মাদকের আসর বসাচ্ছেন বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থকরা। কিছু প্রার্থী এটাকে কাজে লাগিয়ে ভোট বাগানোর চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম, হলসমূহের প্রভোস্ট ও দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অবহেলার কারণে এমনটা ঘটছে।
ক্যাম্পাসে মাদক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদকে সভাপতি করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট একটি মাদক নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, আমরা ইতোমধ্যে একটি মাদক নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন করেছি।
এদিকে জাকসুর নির্বাচন পরিচালনা বিধি অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী নির্বাচন পরিচালনায় কেন্দ্রীয় সংসদের ক্ষেত্রে ৭ হাজার টাকা এবং হল সংসদের ক্ষেত্রে ৪ হাজার টাকার অধিক ব্যয় করতে পারবেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রার্থীরা এসব নিয়মের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না। হলগুলোতে প্রচারণার অংশ হিসেবে বিরিয়ানি বিতরণ করেছেন একাধিক প্রার্থী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল, মওলানা ভাসানী হল, সালাম-বরকত হলসহ ছেলেদের হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনে ভোটারদের নিয়ে খাবারের আয়োজন করেন প্রার্থীরা।
এ বিষয়ে স্বতন্ত্র প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী মো. শাকিল আলী গণমাধ্যমকে বলেন, বিভিন্ন হলে মদসহ অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে, যা নির্বাচনি আচরণবিধিসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের আইনের পরিপন্থি। এ ছাড়া নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গ করে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা হলে হলে বিরিয়ানি সাপ্লাই দিচ্ছেন। ভোটারদের ক্যান্টিনে নিয়ে খাওয়াচ্ছেন। ক্যাম্পাসে মাদক ও টাকার ছড়াছড়ির অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু নির্বাচন নয়, ক্যাম্পাসে কারও বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাকসুতে প্রার্থী হতে পারলেন না অমর্ত্য রায় : জাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে অমর্ত্য রায়কে অংশ নেওয়ার অনুমতি দিতে হাই কোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত করেছেন চেম্বার জজ আদালত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক হাই কোর্টের আদেশ আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। এর ফলে ১১ সেপ্টেম্বর জাকসু নির্বাচন হতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
এর আগে দুপুরে অমর্ত্য রায়ের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্ট তাকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দিতে নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে অমর্ত্যরে প্রার্থিতা বাতিল বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তও স্থগিত করা হয়। তবে হাই কোর্টের আদেশের পর পরই চেম্বার আদালতে যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শুনানি শেষে বিকাল ৫টার দিকে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি হাই কোর্টের আদেশ স্থগিত করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। অমর্ত্যরে পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মানজুর আল মতিন।
প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট সম্পন্ন, ফলাফল আজ : জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্ট সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রার্থীদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের ১০ দিন পর এবং জাকসু নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে ডোপ টেস্ট করার বিষয়কে প্রশাসনের অদূরদর্শিতা ও হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন প্রার্থীরা। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী আবু তৌহিদ মো. সিয়াম বলেন, চূড়ান্ত প্রার্থিতা ঘোষণার আগেই ডোপ টেস্টের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। ইতোমধ্যে ব্যালট পেপারে প্রার্থীদের নাম ছাপা হয়েছে।