পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে এখনো উত্তেজনা কাটেনি। গতকালও এ ইস্যুতে উত্তপ্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাস। চলমান সংকটের সমাধান খুঁজতে ঢাবির ২৩টি ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে সেখানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি তুলে বৈঠক বয়কট করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ), সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (একাংশ) ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএল। এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হল ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর শনিবার দিবাগত রাতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে কিছু শিক্ষার্থী। এ সময় আবাসিক হলের অভ্যন্তরে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও হল কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, গতকাল ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ঢাবির ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে উপাচার্যের কার্যালয়ে আলোচনা সভায় বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সভায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি তোলে বাম রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলো। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিবিরকে সঙ্গে নিয়ে চলার আহ্বান জানান উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান। উপাচার্যের এমন বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ সভা বয়কট করেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ), সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (একাংশ) ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএল। পরে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা ও সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন শুভ; সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট কেন্দ্রীয় সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ ও সাধারণ সম্পাদক রায়হানউদ্দিন এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএলের সভাপতি গৌতম শীল ও কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান যৌথ বিবৃতিতে ঢাবি উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খানের এ বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। নেতারা বলেন, ‘ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সভার শুরুতে আমরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছি। জবাবে উপাচার্য সব ছাত্র সংগঠনের উপস্থিতিতে ঢাবি ছাত্রশিবিরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিয়েছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাত্র শিবিরকে নিয়ে চলার কথা বলেছেন। যা ঢাবির মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধে অবদানকে কলঙ্কিত করে।
তারা বলেন, ‘আমরা ঢাবি উপাচার্যের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণে আমাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করে সভা বয়কট করেছি। মুক্তিযুদ্ধকে ধারণকারী ছাত্র সংগঠন হিসেবে ‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন’ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে আমরা কোনোভাবেই আপস করতে পারি না।’ বৈঠক শেষে ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রস্তাব দিয়েছি হলে ছাত্ররাজনীতি কেমন হবে এটির আনুমানিক একটি স্যাম্পল নিয়ে ই-মেইলের মাধ্যমে ইয়েস-নো ভোটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যেন অভিমত নেওয়া হয়। এবং সেই অভিমতের ওপর ভিত্তিতে অধিকাংশ যে মতামত দেবে, সেই মোতাবেক যেন একটি ফ্রেমওয়ার্ক দেয়।’
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের বলেন, ‘আমরা হলে ও একাডেমিক এরিয়াতে কোনো রকম রাজনৈতিক কাঠামো ও কার্যক্রম রাখতে দেব না এবং আমরা সেটি চাই না। কেননা শিক্ষার্থীরা চায় না সেই দাসত্বের জীবন এবং গণরুম গেস্টরুমের যুগে ফিরে যাবে।’ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ও হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতির এক ধরনের রূপরেখা প্রয়োজন যেন এর বাইরে কেউ কিছু না করতে পারে। গেস্টরুম, গণরুম ও অপরাজনীতির কোনো কালচার যেন না থাকে, সেই বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। অনুরোধ জানিয়েছি, প্রশাসন যেন সাধারণ শিক্ষার্থীর কাছে মতামত নেয়। আমরা আশাবাদী এসবের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি ঐতিহাসিক রূপরেখা প্রণয়ন করবে।’ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ‘ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে গুপ্ত রাজনীতির চর্চা করছে। তারা তাদের হল কমিটিগুলো প্রকাশ করে না। আমরা যেসব ছাত্র সংগঠন আজকের আলোচনায় অংশ নিয়েছি সবাই বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করেছি যেন কোনো গুপ্ত রাজনীতি না থাকে।’ উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘সংগঠনগুলো উচ্চমাত্রার কিছু পরামর্শ দিয়েছে এবং আলোচনা আমরা চালিয়ে যেতে চাই। সামনে ডাকসু নির্বাচন। এই নির্বাচনে ছাত্র সংগঠনগুলোর পূর্ণ ভূমিকা প্রয়োজন। আমরা নির্বাচনটা শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারি এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যাতে কোনোভাবেই আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলো মুখোমুখি না হয়।’ জাবি প্রতিনিধি জানান, (জাবি) ছাত্রদলের হল কমিটি ঘোষণার পর বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভকারীরা আবাসিক হলের অভ্যন্তরে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও হল কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। শনিবার দিবাগত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তাজউদ্দীন আহমদ হল থেকে এ বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। এ সময় তারা ‘হল রাজনীতির বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন; হল পলিটিকসের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও; ওয়ান টু থ্রি ফোর, হল পলিটিকস নো মোর’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসে সব আবাসিক হল প্রদক্ষিণের পর উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান। এ সময় শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের কাছে ছয় দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ, ভবিষ্যতে হলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত শিক্ষার্থী এবং গণরুম ও গেস্টরুমে ‘র্যাগিং’ সংস্কৃতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক শাস্তির সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন, অতি দ্রুত হল সংসদ গঠন করে শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক সংগঠনের যে কোনো উপহারসামগ্রী একমাত্র হল প্রশাসনের মাধ্যমে প্রদান এবং এতে ওই সংগঠনের নাম বা কোনো চিহ্ন ব্যবহার না করা, হলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগতদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ, হলের মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ। সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘আমি তো হুট করে একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে পারি না। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো নিয়ে আমরা একাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা করে নীতিগত সিদ্ধান্ত দিতে পারব বলে আশা রাখি।’