গণমাধ্যমকে গত ১৫ বছর শেখ হাসিনা গলা চিপে ধরেছিল। এর মধ্যে সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তুলে ধরতে পারেননি। আর সম্পাদকরা অনেকে হাসিনার চাপে নিয়ন্ত্রিত ছিল, আবার অনেকে স্ব ইচ্ছায় হাসিনার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছেন। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর গণমাধ্যম স্বাধীন হওয়ার আশা করলেও ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হয়ে যায়। প্রশ্ন করলে চাকরি চলে যায়, মামলা তো রয়েছেই। নতুন করে শুরু হয়েছে মব ভায়োলেন্স। কাকে বের করতে হবে আবার কাকে সংযুক্ত করতে হবে এখন এই চাপেই রয়েছে গণমাধ্যম। সুতারাং গণমাধ্যম এখনো স্বাধীন নয়।
গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : অভিযোগ নিষ্পত্তি ও স্ব-নিয়ন্ত্রণের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ। বক্তব্য রাখেন দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল, গণফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এস এম শামীম রেজা, মাছরাঙা টিভির সম্পাদক রেজওয়ানুল হক রাজা, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক মন্জুরুল ইসলাম, ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, সিনিয়র সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক কাজী জেসিন, বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য মাহমুদা হাবীবা, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোনিয়া জামান খান ও ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিজিএসের প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান।
আলী রীয়াজ বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা শুধু সরকার, মালিকপক্ষ বা সম্পাদকীয় পর্যায় থেকেই আসছে না, এর বাইরেও একটি ‘সামাজিক শক্তি’ সক্রিয় রয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে এমন সামাজিক শক্তির উদ্ভব ঘটে এবং দেশেও তার কিছু প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এখনো ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নেয়নি বলে রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকদের কাছে আমি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি, আপনারা একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি সাংবাদিক নাকি রাজনীতিবিদ? এক বছর আগে জুলাই আন্দোলনের সময় সাংবাদিকদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেছিলেন। উপস্থিত তাঁরা কে কী বলেছিলেন এটা তো জানেন! এটা সাংবাদিকতা? এটাকে আপনি আমি সাংবাদিকতা বলব? রক্ষা করব তাঁকে? মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, আমি ভীত, চিন্তিত। সাংবাদিকরা দৌড়ের ওপরে আছেন। অনেক সাংবাদিক মামলার শিকার, অনেকে দেশ ছেড়েছেন। অনেক সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন। সবাই বলছেন ১৬ বছরের কথা। ৫৪ বছরই তো একই অবস্থা দেখেছি। এখন বলা হচ্ছে সাংবাদিকতা মুক্ত। বাস্তবতা হলো, পক্ষে গেলে মুক্ত, বিপক্ষে গেলেই মব ভায়োলেন্স। ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল বলেন, সংবাদপত্রের যে মিডিয়া হাউসগুলো প্রতিষ্ঠিত তারা একটা কর্পোরেট গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে সংবাদপত্র ঠিক সংবাদপত্রের মতো আচরণ করে না। সে মিডিয়া হাউস কিন্তু সে সংগঠন বা বড় গোষ্ঠীকে তার প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য কাজ করে। ফলে তাদের আর্থিক ভিত্তি হয়তো শক্ত হয়, কিন্তু তার বিপরীতে যখন প্রকৃত সাংবাদিকতার ব্যাপারটি আসে তখন সে আর্থিক ভিত্তিটা শক্ত থাকে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক মন্জুরুল ইসলাম বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে ন্যায্যতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সরকারই ন্যায্যতার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টি করে। জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তিতে সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ১৭০টি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সরকারি তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ প্রতিদিনের নাম সেখানে নেই। একই সঙ্গে কালের কণ্ঠ ও ডেইলি সানের নামও নেই। অক্ষত পত্রিকায় ক্রোড়পত্র দেওয়া হলেও বহুল প্রচারিত পত্রিকায় কেন দেওয়া হলো না? এই প্রশ্ন সরকারের কাকে করব? তিনি আরও বলেন, দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন নানাভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে গণমাধ্যম তত বেশি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক এস এম শামীম রেজা বলেন, সেলফ রেগুলেশনের ব্যাপারটি অনেক জোরেশোরে সামনে আসছে, তার মানে কি আমরা ধরে নিচ্ছি সাংবাদিকরা অন্য আইনি সুরক্ষা পাবেন না? তার ওপর যে অবিচারগুলো হয়, যে চাপগুলো আসে সেগুলা নিরসন করা হবে না, শুধু সেলফ রেগুলেশনে যাব! ব্যাপারটি যেন এরকম না হয়। রেজওয়ানুল হক রাজা বলেন, মিডিয়া কমিশন রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর, কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ ১৫ দফা বিশিষ্ট একটি সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে যেটি তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এর মধ্যে একটি ছিল প্রেস কাউন্সিল বিলুপ্ত করে প্রেস কমিশন গঠন করা। দুর্ভাগ্যবশত সেটি তোয়াক্কা না করে প্রেস কাউন্সিলকে পুনর্গঠন করা হয়েছে। রিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল অলমোস্ট নন এক্সিস্টিং একটা ইনস্টিটিউশনে পরিণত হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। এটি যদি না হতো তবে আইসিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট এগুলার আশ্রয়ে সাধারণ লোকদেরকে গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা ঘটত না।