রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের স্বার্থে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। নতুন এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উচ্চকক্ষের আসনসংখ্যা হতে পারে ৭৬ এবং এসব আসনের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে।
একই সঙ্গে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকায় সেখানেও বিকল্প প্রস্তাব আনা হয়েছে। সেখানে সংরক্ষিত নারী আসন বাদ দিয়ে বিদ্যমান সংসদীয় আসনের নির্বাচনে দলগুলোকে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপের ১৩তম দিনে এ সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তবে দলগুলো ঐকমত্যে পৌছাতে পারেনি। আজ মঙ্গলবার আবারও আলোচনা চলবে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
কমিশন সূত্র জানায়, সংসদের উচ্চকক্ষের নতুন প্রস্তাবের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রতিটি জেলা ও প্রতিটি সিটি করপোরেশন এলাকা উচ্চকক্ষের একেকটি একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকা হিসেবে বিবেচিত বা চিহ্নিত হবে এবং প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকা থেকে সাধারণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে একজন করে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। বর্তমানে দেশে ৬৪টি প্রশাসনিক জেলা ও ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে বিধায় উচ্চকক্ষের আসনসংখ্যা হবে ৭৬। জাতীয় সংসদ (নিম্নকক্ষ) এবং উচ্চকক্ষের নির্বাচন একই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষের নাম প্রস্তাব করা হয় সিনেট। এই কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপারিশ করে যে বাংলাদেশে নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চকক্ষের (সিনেট) সমন্বয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি আইনসভা থাকবে। উচ্চকক্ষ আইনি যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এবং নির্বাহী ক্ষমতার ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে একমত হলেও উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনের বিষয়ে মতভেদ দেখা দেয়। যে কারণে নতুন এই প্রস্তাব আনা হয়েছে।
কমিশনের প্রস্তাবে সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ আসনে উন্নীত এবং সরাসরি নির্বাচনের কথা বলা হয়। নারী আসন বৃদ্ধিতে একমত হলেও সরাসরি নির্বাচনের বিরোধিতা করে বিএনপি ও সমমনারা। এই অবস্থায় সংরক্ষিত নারী আসন বাদ দিয়ে বিদ্যমান সংসদীয় আসনের নির্বাচনে দলগুলোকে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থী নিশ্চিতের কথা বলা হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, সংবিধানে উল্লিখিত সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে ২৫ বা ততোধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মোট প্রার্থীর মধ্যে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থিতা নিশ্চিত করবে।
সংলাপ শেষে প্রেস ব্রিফিং-এ অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সমাজের বিরাজমান বৈচিত্রকে প্রতিনিধিত্ব করতে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু, কী পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন হবে সে ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কমিশন থেকে দুটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, একইসাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায়ও কিছু কিছু প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাব নিয়ে আরো আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
সংসদে নারীদের জন্য স্থায়ীভাবে একশ আসন করার ব্যাপারে সকলে একমত হয়েছেন উল্লেখ করে কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, এক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত প্রশ্ন এখনো রয়েছে। এ পদ্ধতি নির্ধারণে আমরা এখনো একমতের জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় আসন সংখ্যার সংখ্যানুপাতে একশ আসনে উপনীত করা বা সরাসরি নারী আসনে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত এই দুই প্রস্তাবে একমত না হওয়ায় বিগত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি হল, সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ভিন্নভাবে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে যে সকল রাজনৈতিক দল ২৫টির বেশি আসনে প্রার্থী দেয় তাদের মধ্যে থেকে ন্যুনতম এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রার্থী নিশ্চিত করা? এই প্রস্তাবের বাইরেও আলোচনায় আরো কিছু প্রস্তাব এসেছে। তাই বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য কমিশন আলোচনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ও নারী আসন বৃদ্ধির প্রশ্নে বিএনপি আগের অবস্থানে রয়েছে বলে জানান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সংসদে নারী আসন ১০০ তে উন্নীত করার প্রস্তাবে বিএনপি একমত। তবে ওই আসনগুলোতে নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতে হতে হবে। কারণ সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা রয়েছে। তিনটি আসন মিলে একটিতে নারী প্রার্থী বা ৩৩শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বাস্তবতা এখনো আসেনি। আমরা এখনো আরপিও অনুযায়ী দলের কমিটিতে ৩৩শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি। সেখানে ৩৩ শতাংশ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন কিভাবে সম্ভব হবে? তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য আমরা উচ্চকক্ষের বিষয়ে একমত হয়েছিলাম। সেখানে আমরা নিম্নকক্ষের আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু আজ নতুন একটি প্রস্তাব এসেছে, যা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। আজকের আলোচনায় ৬৪টি জেলা ও ১২টি সিটি করপোরেশন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ৭৬ জনের আলাদা করে নির্বাচিত করার প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের প্রধান ও জেলা পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি আছে। সেখানে আবার নির্বাচন করে প্রতিনিধি নির্বাচন অবাস্তব। আর করো কারো প্রস্তাব অনুয়ায়ী পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, দু’টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা উচ্চকক্ষের বিষয়ে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ব্যবস্থা চালুর পক্ষে। অধিকাংশ দল এ বিষয়ে একমত। সংখ্যাগরিষ্টের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে হলে এটাই করতে হবে। নারী আসনের বিষয়েও আমরা একশ আসনে পিআর পদ্ধতির পক্ষে। কারণ নারীদের জন্য একশ আসনে নির্বাচন করতে হলে একজন নারী প্রার্থীকে তিনটি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করতে হবে। এটা অবাস্তব।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করেছে কমিশন। আমরা এর বিরোধী। আমরা তা ৫০ থেকে ১০০তে উন্নীত করার কথা বলেছি। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে। কমিশন এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন বাধ্যবাধকতার কথা বলেছে। আমরা এটি সমর্থন করি। তবে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এজন্য আরো সময় প্রয়োজন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, কমিশনের কর্মকাণ্ড সঙ্গত মনে হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে দলের অভ্যন্তরে ৩০ শতাংশ নারীকে কমিটিতে রাখতে পারছে না, সেখানে ৩০ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়ার সামর্থ্য আছে বলে মনে করি না।
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, বর্তমান ৬৫ অনুচ্ছেদে সংরক্ষিত আসন চায় না কমিশন। আমরা বলেছি, সংরক্ষিত আসন একশ করতে। আর বর্তমান বাস্তবতায় ৩০ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কঠিন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, আমরা বলেছি এবার ৫ শতাংশ দেওয়া যেতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, কমিশন নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী সংরক্ষিত নারী আসন বাতিল ও ৩৩ আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা এই মুহূর্তে অসম্ভব। আমরা বলেছি, সংরক্ষিত আসন রেখে ২০ শতাংশ আসনে নারীদের সরাসরি আসনে ভোট হবে। নারীদের পুরোপুরি অধিকার এখনো নিশ্চিত হয়নি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীকে রাখা হচ্ছে না। এর অবসান হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম নতুন নতুন প্রস্তাব আনায় কমিশনের সমালোচনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, তারা কখনো উচ্চ পর্যায়ের, আবার কখনো নাগরিক সমাজের কথা বলে নতুন প্রস্তাবনা এনে সময় ক্ষেপণ করছে। তারা চাইলে দুই-একদিনের মধ্যেই সব আলোচনা সম্পন্ন করতে পারে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, নারীদের সংরক্ষিত আসন দরকার নেই। বরং তাদের নির্বাচিত হয়েই সংসদে আসা উচিত। এতে তাদের সম্মান আরো বৃদ্ধি পাবে। নারী এখন অনেকটাই স্বয়ং সম্পূর্ণ। বিগত দিনেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তারা নেতৃত্ব দিয়েছে। তিনি নারীদের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার বিপক্ষে।
ঐকমত্য কমিশনের প্রতি এনডিএম মহাসচিবের ক্ষোভ : জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিজেরাই ঐক্য বিলম্ব কমিশনে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম) মহাসচিব মোমিনুল আমিন। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সুষ্পষ্ট বক্তব্য এবং তাঁদের টার্মস অব রেফারেন্স অনুযায়ী যেসব বিষয়ে সকল দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে সেগুলোই জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা? কিন্তু তাঁরা প্রতিনিয়ত ঐকমত্যে না আসা বিষয়ে নতুন প্রস্তাবনা নিয়ে এসে কালক্ষেপণ করছে। তাহলে গত ৬ মাসে ঐকমত্য কমিশনের পেছনে রাষ্ট্রের কত অর্থ খরচ হয়েছে জাতি সেটা জানতে চায়।
মোমিনুল আমিন বলেন, সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত করে কমিশন তিনশ আসনে কোনো দল মনোনয়ন প্রদান করলে বাধ্যতামূলকভাবে ১০০ আসনে নারী প্রার্থী দেওয়ার বিধানের প্রস্তাব করেছে। এটা বাস্তবতা বিবর্জিত। এই একশ আসনে নারী প্রার্থী বিজয়ী হয়ে আসবে তার নিশ্চয়তা কে দিবে? নাকি কমিশন নারী প্রার্থী বিজয়ী করতে হাসিনার মত বিতর্কিত নির্বাচন করতে চায়? তিনি বলেন, নারীর প্রতিনিধিত্ব সংসদে নিশ্চিত করতে হলে শুধু রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান নারী বা নেতার স্ত্রী-নারী বন্ধু দিয়ে সংসদ ভরলে হবে না। আমরা সংরক্ষিত একশ নারী আসনে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছি।