জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা গতকাল থেকে যে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করেছেন, তা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। এতে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে দেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে এনবিআরের বর্তমান অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা। সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ীরা আরও জানান, আন্দোলনের কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন তাঁরা। প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। আবার কাস্টমস কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, অর্থনীতির লাইফ লাইন বন্ধ করে একটি দেশ এভাবে চলতে পারে না। যুদ্ধ ছাড়া একটি দেশের কাস্টমস এভাবে বন্ধ থাকতে পারে না। সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসাবাণিজ্যের পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে করে পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (আইসিসিবি) প্রেসিডেন্ট মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যে কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের মিথস্ক্রিয়া (ইন্টারেকশন) অতীব জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের সংলাপ কিংবা আন্তঃ যোগাযোগ নাই।’ বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, পোশাকশিল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাত। এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে শুধু পোশাকশিল্পে। তাই, শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা, তথা সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে এ মুহূর্তে এনবিআর ইস্যুর আশু সমাধান প্রয়োজন। এটা আমাদের শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়। তিনি বলেন, চলমান স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা চাপে আছেন। নতুন করে এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দেড়-দুই বছর ধরেই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আসছি। বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, এলসি জটিলতা, মুদ্রার অবমূল্যায়ন। এসব মোকাবিলা করে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এখন আবার এনবিআরের আন্দোলন। এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীদের অবস্থা পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো। যাঁরা উৎপাদন সেক্টরে আছেন তাঁরা আজ নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। তাঁদের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।
তিনি আরও বলেন, ‘সমস্যা নিরসনে মোটেও সময় ব্যয় না করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নেতৃত্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অর্থাৎ অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) যৌথভাবে আন্দোলনরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা জরুরি। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় একটি দক্ষ ও হয়রানিমুক্ত এনবিআরের লক্ষ্যে সংস্কার চায়। তবে সে ক্ষেত্রে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ কোনোভাবে কাম্য নয়।’
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘আমরা যারা ব্যবসা করি, আমরা সব সময়ই এনবিআর, কাস্টমসের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই ব্যবসা পরিচালনা করার চেষ্টা করি। বাস্তবতা হলো, আমরা ব্যবসায়ীরা তাদের (এনবিআর কর্মকর্তা) কাছে জিম্মি। বর্তমান আন্দোলন কেবল ক্ষমতার বণ্টন নিয়ে। টাকাপয়সার বণ্টন নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। এরা সারা জীবন আমাদের জ্বালিয়েছে। এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে।’ লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে না। যুদ্ধ ছাড়া কোনো দেশের কাস্টমস বন্ধ থাকে, এটা আমাদের জানা নেই। আমরা এনবিআরের সংস্কার চাই। এনবিআরে অনেক সৎ অফিসার আছেন। বর্তমান সংস্কারের ফলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি বলার অধিকার তাদের আছে। তবে এনবিআরের অফিসারদের ভবিষ্যৎ কী, সে বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) সভাপতি মঈনুল ইসলাম, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বিটিএমএর সাবেক সভাপতি এ মতিন চৌধুরী, তৈরি পোশাকশিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়ক পণ্য সরবরাহকারী কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার প্রমুখ।