রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তন ও তার ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতিসহ অন্যান্য বিষয়ে নানা মত উঠে এসেছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হলেও সংসদ গঠন ও নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। এ আলোচনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
সংলাপ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি পরিবর্তন বিষয়ে একমত হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হয়েছে। উচ্চকক্ষে ১০০ আসনের বিষয়ে মত দিয়েছে দলগুলো। এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, সংলাপে আলোচনা শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, তা স্বচ্ছতার সঙ্গে উল্লেখ করা হবে। বাস্তবতার পরিপ্র্রেক্ষিতে সব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন প্রত্যাশা করাও ঠিক হবে না। কিন্তু, কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হওয়ার সদিচ্ছা রয়েছে। সংলাপে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতা ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ৩০০ আসনের সংসদ সদস্যরা ভোট দেবেন। আর যদি সংরক্ষিত আসনে নারী আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা হয় এবং কমিশনের প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হয় সেখানে উচ্চকক্ষের ১০০ আসন টোটাল ৫০০ আসনের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করতে ভোট দিতে পারবেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষ ১০০ সদস্যের বিষয়ে অনেকেই মত দিয়েছেন। তবে সংসদের দ্বিকক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে এখনো একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আলোচনায় এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, গণঅধিকার পরিষদসহ অধিকাংশ দল সংখ্যানুপাতিকে উচ্চকক্ষের পক্ষে মত দিয়েছে। জামায়াত উভয়কক্ষকে সংখ্যানুপাতিক করার পক্ষে। আর বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম নিম্নকক্ষের আসন অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসনে নির্বাচনের পক্ষে। টানা দুই মেয়াদের পর গ্যাপ দিয়ে আবারও একজন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন বলে মত দিয়েছে বিএনপি। তবে একই ব্যক্তি পর পর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বলে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ায় গত তিন দিনের আলোচ্য বিষয়গুলো নিয়ে আগামী রবিবার আবারও আলোচনা হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইলেকটোরাল কলেজপদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, ইলেকটোরাল কলেজে ইউপি মেম্বার থেকে শুরু করে ৭০ হাজার জনপ্রতিনিধি ভোটার হিসেবে থাকবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কয়েকটি মতামত তুলে ধরেছে। সংসদ যদি উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে বিভক্ত হয়, তাহলে ৫০০ ইলেকটোরাল কলেজ। আরেকটি প্রস্তাব হলো, উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সদস্যদের পাশাপাশি জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে ৫৭৬ ইলেকটোরাল কলেজে উন্নীত করা। তৃতীয় মতটি হলো ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব। জামায়াতে ইসলামী তিনটির যেকোনো প্রস্তাবকে গ্রহণ করতে রাজি আছে বলে জানান আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, সংখ্যার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান নমনীয় থাকবে। তবে ইলেকটোরাল কলেজ বৃদ্ধির প্রস্তাব গ্রহণ করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের শর্তারোপ করেছে জামায়াতে ইসলামী। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সুষ্ঠু হওয়া জরুরি। না হলে যারা ভোটার থাকবেন, তাদের মতামত প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে।
গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব করেছে কয়েকটি দল। ওই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি জানান, নিম্নকক্ষের সমানুপাতিক ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষে ১০০ সদস্য নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি। উচ্চ ও নিম্নকক্ষের ৫০০ সদস্যের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, এখনো সরকারের সব জায়গায় ফ্যাসিস্টের দোসররা বসে আছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি সরকার। এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সৎ, যোগ্য, সুনামসম্পন্ন, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার বিধান করার জন্য বলেছি। ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধিত হলে সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি পদে যেকোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে। এটি বিবেচনা করে গোপন ব্যালটে ভোট প্রদান করা যেতে পারে বলে আমরা বলেছি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী পরপর দুই মেয়াদের বেশি না থাকার পক্ষেই আমরা মতামত দিয়েছি।
নুর ও ইরানের ক্ষোভ : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ১৪ দলীয় মহাজোটের দুই শরিক দলকে আমন্ত্রণ জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর ও বাংলাদেশের লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। ইরান বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের দুই শরিক বাংলাদেশ জাসদ ও জাকের পার্টিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এটি জুলাই আকাঙ্ক্ষার প্রতি কুঠারাঘাত। আগামীতে তাদের আমন্ত্রণ জানালে আমরা সংলাপ বয়কট করব। নুরুল হক নুর বলেন, সংলাপে ফ্যাসিবাদের দোসর দুটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি জুলাইয়ের চেতনার প্রতি সুস্পষ্ট অবমাননা। আমরা এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইব।