৫ আগস্টের পর দেশে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত শব্দ মব। শুরুতে এটাকে মব জাস্টিস বলা হলেও এখন পরিণত হয়েছে মব ফ্যাসিজমে। সরকারি অফিস থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বড় ব্যবসায়ী থেকে মুদি ব্যবসায়ও হানা দিয়েছে এ মব ফ্যাসিজম। বৈষম্যবিরোধী নামধারী কিছু টাউট, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ এবং কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এ মব ফ্যাসিজমের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী নেতা পরিচয়ে অনেকেই পাড়ামহল্লায় মব সৃষ্টি করে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গ্যাং তৈরি করছে বলে জানা গেছে। মব ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকার এ মব ফ্যাসিজম ঠেকাতে ৯০ ভাগ ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আবার এটাকে মারাত্মক ছোঁয়াচে অসুখ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের ভাষায়, এটা একবার শুরু হলে রাষ্ট্র ও সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান বাস্তবতায় মব এমনই অসুখ হিসেবে পরিণত হয়েছে বলে তাদের ধারণা। মব ফ্যাসিজম প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা জানান, এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এখনই কঠোর হাতে দমন করার মিশনে নামতে হবে। তবে রাতারাতি এটা দূর করা সম্ভব নয়। এজন্য সময় লাগবে বলে তাদের অভিমত। সংশ্লিষ্টরা জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। দেশজুড়েই যেন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে বিষয়টি। আজ কুষ্টিয়া তো কাল ঢাকায়। পরদিন সিলেটে। এতে আক্রান্ত হচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ থেকে সাধারণ মানুষ। বিশ্লেষকরা জানান, খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মব ফ্যাসিজমের ঘটনা বাড়ছেই। রাষ্ট্রের ন্যূনতম যে শৃঙ্খলা, তা এখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। স্থিতিশীলতা আসেনি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কঠিনভাবে দক্ষতার সঙ্গে যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, তারা সেটা নেননি।
মব ফ্যাসিজমে সরকারের ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখছে ছাত্র-তরুণদের গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ প্রসঙ্গে দলটির যুগ্ম-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে গণ অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক স্পেসটা উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগটাকে নানাজন নানা ভাবে নিচ্ছে। অপব্যবহারও হচ্ছে। যার যার গোষ্ঠীস্বার্থে অনেকে অনেক সময় এ ধরনের মব করছে। যেটা জুলাই গণ অভ্যুত্থান আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ মব আর ইনসাফ একসঙ্গে যায় না। তিনি বলেন, মব নিয়ন্ত্রণে সরকার ৯০ ভাগ ব্যর্থ। এ নিয়ে শুধু কিছু লিপ সার্ভিসিং দেখেছি। সরকার যদি এ বিষয়ে কঠোর থাকত অর্থাৎ আগে যারা মব করেছে তাদের শাস্তি দিত তাহলে অন্যরা সাবধান হতো। আর দলীয়ভাবে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মবের বিষয়ে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের গাফিলতির সুযোগে মব ফ্যাসিজমের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এটাকে ছোঁয়াচে অসুখ বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিই হোক মব কোনো সমাধান নয়। মবটা আসলে একটা ছোঁয়াচে রোগের মতো। যে কোনো কারণেই হোক, যে ব্যাখা বিশ্লেষণে হোক মবকে একবার আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলে সেটা ছড়িয়ে যাবে। তখন এটা ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে, ঐতিহাসিক কোনো যৌক্তিক বিষয়ে মব হবে। ভাঙচুর হবে। কারও কর্মস্থলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা হবে। এতে রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি হবে। সবমিলিয়ে নানা ধরনের নৈরাজ্য তৈরি হবে। এটা সমাজে একটা রীতি বা কালচারে পরিণত হতে পারে। ড. তৌহিদুল হক বলেন, মব এরই মধ্যে নাগালের বাইরে চলে গেছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা এখন খুব কষ্টসাধ্য। তবে এটা ঠিক, মবের ক্ষেত্রে এ সরকার শুরু থেকে নীরব ভূমিকায় ছিল। এতে মবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সাহসটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে মব ফ্যাসিজম নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সরকারকে এখনই কঠোর হতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে মব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জে ফেলবে। এ প্রসঙ্গে সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোস্তাফা কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মবকে কখনই জাস্টিফাই করা যায় না। এটা করা মানে হলো দেশে আইনের শাসন নেই। দোষী বা অপরাধী হলে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, মব করে নয়। তিনি বলেন, একটা মব ভায়োলেন্স আরও ১০টা মব ভায়োলেন্স তৈরি করে। একই প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাইদ হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জনগণের ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকায় সরকার চলে। জনগণের চাহিদা পূরণ করা সরকারের দায়িত্ব। বিশেষ করে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য পুলিশ-বিজিবি-আনসারের মতো অনেক মেশিনারিজ আছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও তো এখনো মাঠে কাজ করছে। অনেক গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। আইন অনুযায়ী ‘মব’ যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন? সরকারের মেশিনারিজগুলো কি সত্যিই পারফর্ম করতে পারছে?