তিন মাসের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে পারলেও অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ পার করেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারেনি। এজন্য দেশে নানান ধরনের রাজনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদরা।
কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার চাইলেই ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দিতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যে সেই সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। বরং নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।’ তাঁরা বলেন, ‘সরকার কিছু সংস্কারের কথা বলে সময় ক্ষেপণ করতে চাচ্ছে। এটা ঠিক নয়। যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে তা ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব।’
রাজনীতি বিশ্লেষকরা জানান, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ছয়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। এ ব্যবস্থা ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রবর্তিত হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যবস্থা বাতিল করে এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলো নির্বাচিত সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় মূলত নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ প্রশাসনের আওতায় নির্বাচন পরিচালনার জন্য। ১৯৯০ সালে, ১৯৯৬ সালে (দুটি), ২০০১ সালে, ২০০৬ সালে ও ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। এর মধ্যে ১৯৯০ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৮৩ দিনের মধ্যে, ১৯৯৬ সালে ৭৪ দিনের মধ্যে ও ২০০১ সালে ৭৮ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে। তখন নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হয়নি। ওই সময় সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছিল। তবে পরিস্থিতি ছিল জটিল ও অস্থির।
রাজনীতিবিদদের দাবি, বর্তমান সরকার নির্বাচনের ব্যপারে গড়িমসি করছে কয়েকজন উপদেষ্টার পরামর্শে। তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে এরই মধ্যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার এরই মধ্যে তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ পার করেছে। কিন্তু ১০ মাস পরেও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন নিয়ে আশ্বস্ত হতে পারছে না। তার মানে নির্বাচন নিয়ে এখনো সন্দেহের দোলাচল চলছে। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানান ধরনের সন্দেহ দেখা দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার সমাধান হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। তারা এখন এমন সব এজেন্ডা নিয়ে হাজির হচ্ছেন যেগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ারের বাইরে। সরকারের একেক উপদেষ্টা একেক বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে তাঁদের নিজস্ব অন্য কোনো এজেন্ডা রয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করছে সংস্কার ও নির্বাচনের বাইরেও তাঁদের অন্য কোনো এজেন্ডা আছে।’
একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘বর্তমান সরকার ইচ্ছা করলেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারে। তারা ইচ্ছা করছেন না, এ কারণে নির্বাচন দিতে পারছেন না। আমার জানা মতে, নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিয়ে রয়েছে। সরকার যদি তাদের শুধু বলে আপনারা নির্বাচনটা আয়োজন করেন তারা করতে পারে। আমরা শুধু নির্বাচন চাই না, আমরা চাই প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন। সেটাও এ সময়ে খুবই সম্ভব। আসলে এসব নির্ভর করছে সরকারের ওপর।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি, সম্প্রতি রাজনৈতিক যে উত্তাল পরিস্থিতি সে পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো উপদেষ্টা বলার চেষ্টা করছেন- আমরা শুধু নির্বাচন করার জন্য আসিনি। আসলে তাঁদের বক্তব্যে সংকট তৈরি হচ্ছে।’
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে না পারায় বর্তমান সরকারের দক্ষতা ও আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন বিলম্ব করার এক ধরনের ইচ্ছা রয়েছে এ সরকারের। বিভিন্ন কারণে তারা যথাসময়ে নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। আমরা মনে করি নির্বাচন দিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসের বেশি সময় নেওয়ার কোনো কারণ নেই। নির্বাচন দিলে সব সমস্যার সমাধান হবে। নির্বাচন বিলম্বিত হলে নানান ধরনের সংকট তৈরি হবে।’