এ যেন রূপকথার চেয়েও অবিশ্বাস্য এক অধ্যায়! দীর্ঘ ছয় বছরের আইনি লড়াই আর মানসিক যুদ্ধ শেষে, বিশ্বসংগীতের মহাতারকা টেলর সুইফট (৩৫) অবশেষে নিজের প্রথম ছয় অ্যালবামের মাস্টার রেকর্ডিংয়ের মালিকানা ফিরে পেলেন। এই খবর শুনে বিশ্বজুড়ে তার কোটি কোটি ভক্তের মধ্যে যেন আনন্দের জোয়ার। ৩৫ বছর বয়সী এই মার্কিন গায়িকা নিজেই তার ওয়েবসাইটে ভক্তদের জানিয়েছেন এই সুসংবাদ, যা তার কাছে ছিল এক অতি অসম্ভব মনে হওয়া স্বপ্ন।
আমি যেসব গান লিখেছি, গেয়েছি, রেকর্ড করেছি—সব এখন আমার! সুইফট লিখেছেন, যেদিন জানতে পারলাম সত্যিই এটা ঘটছে, আনন্দে কেঁদে ফেলেছি। তার এই কথাগুলোই প্রমাণ করে, এই লড়াই তার কাছে কতটা ব্যক্তিগত এবং আবেগপ্রবণ ছিল। তিনি আরও যোগ করেছেন, বলতে গেলে, এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নপূরণ।
এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল ২০১৯ সালের জুনে, যখন সংগীত পরিচালক স্কুটার ব্রন টেলর সুইফটের সাবেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বিগ মেশিন রেকর্ডস কিনে নেন। এর ফলে ব্রন রাতারাতি সুইফটের প্রথম ছয় অ্যালবাম 'টেলর সুইফট', 'ফিয়ারলেস', 'স্পিক নাউ', 'রেড', '১৯৮৯' এবং 'রেপুটেশন'-এর মালিক বনে যান। নিজের গানের মালিকানা হারিয়ে ক্ষুব্ধ সুইফট বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, এ ঘটনা তার হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, আমার জীবনের শ্রমকে কেউ এভাবে ছিনিয়ে নিতে পারে, ভাবতেও পারিনি।
কিন্তু সুইফট চুপ থাকেননি। নিজের অধিকার ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে তিনি ঘোষণা দেন, পুরোনো গানগুলো তিনি আবার নতুন করে রেকর্ড করবেন। যা পরবর্তীতে 'টেলরস ভার্সন' নামে পরিচিতি পায়।
'মাস্টার রেকর্ডিং' হলো একটি গানের মূল রেকর্ডকৃত সংস্করণ। যিনি এর মালিক, তিনিই নির্ধারণ করেন গানটি কোথায় এবং কীভাবে ব্যবহৃত হবে—স্ট্রিমিং, সিডি, সিনেমা, ভিডিও গেম—সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই থাকে। টেলর সুইফট সবসময় তার গানের লেখক হিসেবে প্রকাশনা অধিকার নিজের কাছে রেখেছিলেন। কিন্তু ২০১৯ সালে ব্রন যখন মাস্টার রেকর্ডিংয়ের মালিকানা নিয়ে নেন, তখন সুইফটের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গান ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হয়, যা তিনি কখনও চাননি।
সুইফট এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, আমি চাই আমার গান বাঁচুক, সিনেমায় থাকুক, বিজ্ঞাপনেও বাজুক। কিন্তু তখনই, যখন আমি গানগুলোর মালিক। এই বাক্যটিই তার দীর্ঘদিনের স্বপ্নের প্রতিফলন।
মাস্টার রেকর্ডিংগুলোর সঠিক মূল্য প্রকাশ করা না হলেও ২০২০ সালে এগুলো ৩০০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছিল। পরে ব্রন ক্যাটালগটি লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক শ্যামরক হোল্ডিংসের কাছে বিক্রি করে দেন। আর এই শ্যামরকের কাছ থেকেই সুইফট তার স্বপ্নের মালিকানা কিনেছেন! টাকার অঙ্ক প্রকাশ না হলেও একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বিলবোর্ডকে জানিয়েছে, প্রথম ছয় অ্যালবামের মালিকানা ফিরে পেতে সুইফটকে খরচ করতে হয়েছে ৩৬০ মিলিয়ন ডলার বা ৭ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা!
'টেলরস ভার্সন' হিসেবে ইতিমধ্যেই চারটি অ্যালবাম নতুন করে রেকর্ড করেছেন সুইফট। প্রতিটি রেকর্ডই মূল গানের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন, তবে ছিল আধুনিক রেকর্ডিং প্রযুক্তির ছোঁয়া এবং অতিরিক্ত নতুন গান। বিশেষ করে ১০ মিনিটের 'অল টু ওয়েল'-এর নতুন সংস্করণ ভক্তদের জন্য ছিল এক বিশেষ পাওয়া। তবে, তার 'রেপুটেশন' অ্যালবামের নতুন সংস্করণ নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল। গায়িকা জানিয়েছিলেন, ২০১৭ সালের এই অ্যালবামটি নতুন করে রেকর্ড করতে গিয়ে তিনি বারবার আটকে যাচ্ছিলেন, কারণ এটি ছিল কানইয়ে ওয়েস্টের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নিয়ে।
তবে, আশার কথা হলো, সুইফট তার অভিষেক অ্যালবাম 'টেলর সুইফট'-এর নতুন রেকর্ডিং সম্পন্ন করেছেন। তিনি নিশ্চিত করেছেন, পুরোনো অ্যালবামের মালিকানা ফিরে পেলেও ছয় অ্যালবাম নতুন করে রেকর্ড করার যে প্রক্রিয়া তিনি শুরু করেছিলেন, সেটা চলমান থাকবে। তিনি লিখেছেন, দুই অ্যালবাম অবশ্যই আসবে। তবে এখন আর কোনো দুঃখ নেই, এবার আসবে উৎসব আর উদ্যাপনের আবহ নিয়ে।
১৪ বছর বয়সে ন্যাশভিলে এসে বিগ মেশিন রেকর্ডসের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন সুইফট। সেসময় মাস্টার রেকর্ডিংয়ের মালিকানা প্রযোজনা সংস্থার কাছে থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ২০১৮ সালে চুক্তি শেষ হলে তিনি রিপাবলিক রেকর্ডসে চলে যান। এরপর স্কুটার ব্রনের হাতে তার গানের মালিকানা চলে যাওয়ার খবরে তিনি এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যে, সেসময় ব্রনকে এই ইন্ডাস্ট্রি বিষাক্ত পুরুষতন্ত্রের প্রতীক বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন।
এই দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে টেলর সুইফট কেবল নিজের অধিকারই ফিরে পাননি, তিনি নতুন শিল্পীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন, যখন নতুন শিল্পীরা আমাকে বলে, তারা চুক্তি করার সময় মাস্টার রেকর্ডিংয়ের অধিকার নিজেদের কাছে রাখছে; তখন খুবই আনন্দিত হই। বুঝতে পারি আমার লড়াই কতটা সার্থক।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল