ঢাকাই চলচ্চিত্রে সর্বশেষ সফল পর্দা জুটি হিসেবে ধরা হয় শাকিব-অপু ও শাকিব-বুবলীকে। এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও নতুন কোনো জুটি আর গড়ে উঠছে না। কিন্তু কেন? এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, ১৯৬১ সালে মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে প্রথমবারের মতো জুটি বাঁধেন রহমান-শবনম। প্রথম ছবিতেই এই জুটিকে দারুণভাবে গ্রহণ করেন দর্শক। তাঁরা হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সফল জুটি। শুরু হয় এ দেশের চলচ্চিত্রে জুটি প্রথা। রহমান-শবনম জুটি বাংলা ও উর্দু, দুই ভাষাতেই সফল। চান্দা, তালাশ, দরশন, জোয়ার-ভাটা, পিয়াসা তাঁদের উল্লেখযোগ্য ছবি। অন্যদিকে চলচ্চিত্র শিক্ষক ও পরিচালক মতিন রহমান মনে করেন, জুটি গড়ে ওঠার পেছনে পরিচালক ও গল্পকারদের বড় একটা ভূমিকা থাকে। এরপর নায়ক-নায়িকার অভিনয়, পর্দায় দুজনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যদি সমপরিমাণ থাকে তাহলে দর্শকই বুঝে নেন তাঁরা জুটি। কিন্তু একজনের অভিনয় পছন্দ হচ্ছে কিন্তু আরেকজনকে তাঁর প্রতিক্রিয়ার জন্য ভালো লাগছে না, তখন তাঁদের আর জুটি বলা যায় না। একসঙ্গে অভিনয় করছেন ঠিকই, কিন্তু দর্শক তাঁদের জুটি ভাবতে পারছেন না। জুটির আবেদন সারা পৃথিবীতে আছে, এ আবেদন কখনো ফুরাবার নয় উল্লেখ করে মতিন রহমান বলেন, ‘জুটি প্রথায় সিনেমা হিটও হয়। আমাদের দেশে যে জুটি প্রথা গড়ে উঠেছিল, এখন সেটা পতনের দিকে। কারণ হতে পারে মনোযোগ ও অনুশীলনের অভাব। পরিচালকরাও হয়তো ঠিকমতো তাঁদের উপস্থাপন করতে পারছেন না। আর প্রযোজকরা হয়তো সেভাবে জুটিকে পছন্দ না করে একজন সুপারস্টারকে নিয়ে সিনেমা করছেন।’
এরপর জুটি গড়ে ওঠে আজিম ও সুজাতাকে ঘিরে। এই জুটির প্রথম সিনেমা ‘রূপবান’। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া লোককাহিনিনির্ভর ‘রূপবান’ ছিল সে সময়ের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। ষাটের দশকে আরও একটি সফল জুটির নাম রহমান ও শবনম। শবনম অবশ্য তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু সিনেমায় অভিনয় করে নাদিমের সঙ্গে জুটি গড়েছিলেন। পরে রহমান ও শবনম জুটি গড়ে ওঠে। রহমান-শবনম জুটির বিখ্যাত সিনেমা ‘রাজধানীর বুকে’। তাদের কয়েকটি আলোচিত সিনেমার নাম ‘চান্দা’, তালাশ, ‘দরশন’। বাংলাদেশের সিনেমায় সর্বকালের সেরা ও সফল জুটি বলা হয়ে থাকে রাজ্জাক ও কবরীকে। রাজ্জাক ও কবরীর অনেক সফল সিনেমা রয়েছে। ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘আবির্ভাব’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘রংবাজ’ এবং ‘স্বরলিপি’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’ প্রভৃতি। রাজ্জাকের পর নায়ক আলমগীরের সঙ্গে শাবানার জুটি বেশি সফলতা পায়। তারা জুটি হয়ে ১২০টি সিনেমায় অভিনয় করেন। আরেকটি সফল জুটি জাফর ইকবাল ও ববিতা। তাদের প্রেম-ভালোবাসা নিয়েও ঢাকার সিনেমাপাড়া সে সময় সরব ছিল। এরপর ফারুক ও ববিতা জুটি এবং ফারুক ও কবরী জুটিও আলোচনায় এসেছে এবং দর্শকরা তাদের গ্রহণ করেছেন। ফারুক ও কবরী অভিনীত ‘সুজন সখী’ বছর ধরে সিনেমা হলে চলেছে। এরপর ‘সারেং বউ’ সিনেমায় ফারুক ও কবরী অভিনয় করেন। আবার ফারুক ও ববিতা অভিনীত ‘নয়নমণি’ সিনেমাটি সে সময় ব্যাপক ব্যবসাসফল হয়। তারপর ফারুক ও ববিতা অভিনয় করেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এবং ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রে। এরপর ইলিয়াস কাঞ্চন- চম্পার ভালো একটি জুটি গড়ে ওঠে। এই জুটির সফল সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘সহযাত্রী’ ও ‘ভেজা চোখ’। পরে চম্পার সঙ্গে জুটি গড়েন নায়ক মান্না। ৯০ দশকের সেরা জুটি হিসেবে আগমন ঘটে নাঈম ও শাবনাজের। ‘চাঁদনী’ সিনেমা দিয়ে তারা সবার মন কেড়ে নেন। তাদের পর জুটি হিসেবে সফলতা পান সালমান শাহ ও মৌসুমী। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে শুরু। মাত্র চারটি সিনেমা করেছে এই জুটি। এরপর সালমান শাহ জুটি গড়ে তোলেন শাবনূরের সঙ্গে।
অন্যদিকে মৌসুমী জুটি গড়ে তোলেন ওমর সানীর সঙ্গে। সালমান শাহ মারা যাওয়ার পর শাবনূর জুটি গড়ে তোলেন রিয়াজের সঙ্গে। অনেক পরে এসে ঢাকাই চলচ্চিত্রে আরও এক জুটি সফলতা পায়। তারা হলেন শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস। এই জুটি ৭০টির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছে। এরপর শাকিব খান ও বুবলী জুটি হিসেবে অভিনয় করেছেন বেশ কয়েকটি সিনেমায়। এ জুটিও সাফল্য পায়। ব্যস, এ পর্যন্তই। ঢাকাই চলচ্চিত্রে আর কোনো নতুন নায়ক-নায়িকা এখন পর্যন্ত জুটি প্রথায় সফলতা দেখাতে পারছেন না।