একটি সুস্থ ও আদর্শ সমাজের জন্য ভালো বা নেক কাজ করা যেমন জরুরি তেমনি মন্দ বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও জরুরি। সামর্থ্যবান বা পদস্থ ব্যক্তিরা যখন অন্যায়-জুলুম দেখে চুপ থাকেন তখন অন্যায় ও জুলুম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে এবং তা অন্যায়ের পক্ষে দলিল হয়ে দাঁড়ায়। সমাজে অন্যায় বাড়তে থাকে। প্রতিটি অন্যায় ও জুলুমের ব্যাপারে অন্যায়কারীরা যেমন দায়ী ঠিক তেমনি যারা শক্তি থাকার পরও ‘কী দরকার প্রতিবাদ করার’ ভেবে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন তারাও দায়ী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বারবার অন্যায়ের প্রতিবাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করাকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করবে।’ সুরা আলে ইমরান : ১১০। সামর্থ্যবান লোককে অন্যায়ের শুধু প্রতিবাদ নয়, তা প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আবু সায়িদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ কোনো অন্যায় হতে দেখলে সে যেন হাত দিয়ে তা প্রতিহত করে। যদি তা না পারে, তবে কথা দিয়ে (যেন তার প্রতিবাদ করে); তা-ও না পারলে অন্তর দিয়ে (ঘৃণা করবে)। আর এটি (শুধু ঘৃণা করে বসে থাকা) ইমানের সবচেয়ে দুর্বল স্তর।’ সহিহ মুসলিম : ৭৪।
অন্যায়ের প্রতিবাদ শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়, এক মহান ইবাদত। কখনো কখনো ক্ষমতাবান লোকদের সামনে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ন্যায়সংগত কথা বলা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এ কঠিন পরিস্থিতিতেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে হাজারো মানুষ জুলুম-নির্যাতন থেকে বেঁচে যায়। এজন্য প্রভাবশালীদের সামনে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোত্তম জিহাদ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘জালিম শাসকের সামনে ন্যায়সংগত কথা বলা উত্তম জিহাদ।’ আবু দাউদ : ৪৩৪৪।
সমাজের মানুষ যখন নিজের ওপর জুলুম-নির্যাতন না আসা পর্যন্ত অন্যায় দেখে প্রতিবাদ না করে তখন আস্তে আস্তে পুরো সমাজে অন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে শাস্তির ঘোষণা করেছেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আবু বকর (রা.) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যদি মানুষ কোনো মন্দ কাজ দেখে এবং তা প্রতিরোধ না করে, তবে আল্লাহ শিগগিরই তাদের সবাইকে শাস্তির সম্মুখীন করবেন।’ তিরমিজি : ২১৬৮। অন্যায় প্রতিহত বা এর প্রতিবাদ না করার ভয়াবহ শাস্তিগুলোর একটি হলো দোয়া কবুল না হওয়া। হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, তোমরা অবশ্যই মানুষকে ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না কর তাহলে আল্লাহ তোমাদের ওপর তার পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন। এরপর তোমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেও তিনি কবুল করবেন না।’ তিরমিজি : ৪০৬।
‘আমি তো ভালো আছি, অন্যের ওপর জুলুম হলে আমি কেন প্রতিবাদ করব’ ভেবে যারা জুলুম ও অন্যায় দেখেও নীরবে সয়ে যায় একটা সময় সমাজ এতটাই অন্ধকার হয়ে পড়ে, তাদের ওপরও জুলুম ও অত্যাচার নেমে আসে। পরকালীন শাস্তি তো আছেই, দুনিয়াতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নু’মান ইবনে বাশির (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যারা মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যারা সীমা লঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা লটারির মাধ্যমে দ্বিতলবিশিষ্ট এক জাহাজে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করল। তাদের কেউ স্থান পেল ওপর তলায় আর কেউ নিচতলায়। আর পানির ব্যবস্থা ছিল ওপর তলায়। নিচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহকালে ওপর তলার লোকদের ডিঙিয়ে যেত। তখন নিচতলার লোকেরা বলল, ওপর তলার লোকদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নিই তবেই তো ভালো হয়। এমতাবস্থায় ওপর তলার লোকেরা যদি তাদের আপন মর্জির ওপর ছেড়ে দেয় (এর প্রতিবাদ না করে) তাহলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে) তবে তারা এবং সবাই রক্ষা পাবে।’ সহিহ বুখারি : ২৪৯৩।
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ ও পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর