আমরা দৈনন্দিন জীবনে শহরকেন্দ্রিক সভ্যতায় দেখতে পাই প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য, খাবারের আবর্জনা,স্তূপীকৃত জঞ্জাল ভোরবেলায় রাস্তা বা আশপাশে পাহাড় প্রমাণভাবে ফেলে রাখা হয়। এ দুর্গন্ধযুক্ত বর্জ্য পদার্থ পরিবেশকে দূষিত করে। এ বিশাল পরিমাণ আবর্জনারই অতি ক্ষুদ্র অংশ গরিবেরা কুড়িয়ে তাদের জীবিকানির্বাহ করে। কিন্তু বাদবাকি বিশাল খাবারের বর্জ্য পদার্থ আশপাশে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে দূষণ ছড়িয়ে স্বাস্থ্যহানি ঘটায় ও নানা ধরনের ক্ষতিসাধন করে। এখন সেগুলো থেকেই তৈরি হচ্ছে সার।
এগুলোকে সারে পরিণত করার জন্য এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশেষ প্রজাতির লাল কেঁচো ব্যবহার করা হয়। এয়ারবিট ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু বাতাস বা অক্সিজেনের সাহায্যে মাইক্রব বা এইজাইম দ্বারা জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায় ও ক্যান্টিন বা রেস্তোরাঁ থেকে ফেলা ভেজিটেবল খাবারগুলোকে জৈবসারে রূপান্তরিত করে।
এ কেঁচোগুলো ভার্মি পিটে ছাড়ার পর মাটির তলায় চলে যায় বর্জ্য পদার্থের মধ্যে দূষিত পদার্থ যথা গন্ধক, নাইট্রোজেন আছে, যা দুর্গন্ধের সৃষ্টিকারক তা বন্ধ করে দেয়। এ কেঁচো ও জীবাণুর সমষ্টি, কেঁচোর বর্জ্য পদার্থ ও ডিম খাবারের সঙ্গে জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া করে কালো গ্র্যাপুলার সার বা ঝুরঝুরে মাটিতে রূপান্তরিত করে। এ মাটির মতো দেখতে সার চাষবাসের পক্ষে দুর্দান্ত কাজ দেয়।
রাসায়নিক সার যা চলিত সার হিসেবে বাজারে বিক্রি হয়, সেটা পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক। দেখা গেছে, ছয়টি কেঁচো যদি পরিবেশগত সাহায্য পায় যেমন অমণ্ডত্ব বা ক্ষারত্বের পরিমাণ, জলীয় ভাগ ও আর্দ্রতা ভালো থাকে, উত্তাপ ও খাবারের ভাগের পরিমাণ সঠিক থাকে, তাহলে তিন মাসে ওই কেঁচোর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার এবং তারা ক্রমশ বেশি পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ ও খাদ্য গ্রহণ করতে পারে।
উল্লেখ্য, ফেলে দেওয়া খাবার বলতে সবুজ শাকসবজি, ফলমূলের খোসা, চা-পাতা, ভাত, ডাল, শিঙাড়া, বিস্কুট, ফাস্টফুড যেমন চাউমিন, নুডলস, ঘাস, শুকনো পাতা, গলা ভাতের ফ্যান ইত্যাদি। এখানে তাপমাত্রা রাখতে হবে ১০ থেকে ৪০ ডিগ্রি, পিএইচ নিউট্রাল ও বেডে পানি ¯েপ্র করে স্যাঁতসেঁতে বা আর্দ্র রাখতে হবে। বেড তৈরি করা হবে প্রথমে ইটের আস্তরণ, তারপর নারকেলের ছোবড়া ও লাল কেঁচোর প্রজাতি যেমন আয়সেনা ফোটেডা, লুবিরিয়াস লুমব্রিকাস ও ফেরিটিমা গেটের আস্তরণ। তারপর শুষ্ক গোবর সার ও পরের আস্তরণ মাটি। সবচেয়ে ওপরে থাকবে ফেলা খাবারের আস্তরণ। প্রত্যন্ত গ্রামে এ বিশেষ ধরনের লাল প্রজাতির কেঁচো পাওয়া যায়। এরা বাতাসে দুর্গন্ধ ভেসে আসে এমন পচা খাদ্যকে জৈবসারে রূপান্তরিত করতে পারে এবং এতে কোনো দুর্গন্ধ থাকে না। মোটামুটি তিন মাসে এ স্তূপীকৃত বর্জ্য খাদ্যের ওপর জমা বস্তু উৎকৃষ্ট সারে পরিণত হয়। যেহেতু কেঁচোগুলো পিটের নিম্নস্তরে থাকে ও বংশ বৃদ্ধি করে, কেবল ফেলে দেওয়া খাদ্য অর্থাৎ উপরিভাগের স্তূপ সাবধানে বেলচা দিয়ে তুলে নেওয়া হয়, যাতে নিচের স্তরে অবস্থিত কেঁচোগুলোর কোনো ক্ষতি না হয়। এ প্রক্রিয়া ক্রমাগত তিন মাস চলতে দেওয়া হয়, অর্থাৎ খাবার ফেলা ও পানি ঢালাও হয় সাবধানে। কেঁচোর সংখ্যা বাড়লে আবার আরেকটি ভার্মিপিট তৈরি করা যেতে পারে।
বিদেশে এভাবে কেঁচো বংশ বৃদ্ধি করিয়ে লাভজনক ব্যবসার প্যাকেজ তৈরি করা হয় ও বিদেশে এরকম কেঁচো বিক্রি করা হয়। এ সার বা ভার্মি কমপোস্ট ব্যবহার করে যে কোনো চাষাবাদ থেকে ভালো উৎপাদন পাওয়া যায়।
এখানে কেঁচোগুলোকে রাখা হয় আলো-ছায়ার মাধ্যমে অর্থাৎ গাছ বা কোনো দেয়ালের কাছে। কেঁচো ও খাবারের পরিমাণ রাখা হয় ২:১ ওজন হিসেবে। এ কেঁচোর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। দেখা গেছে, শক্ত জমি ও মরুভূমিতে এ সার ব্যবহার করে বৃক্ষরোপণ করা যায়। যেখানে কোনো গাছ উৎপাদন করা সম্ভবপর নয়, সেখানে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সিমেন্ট ও বালির সঙ্গে এ জৈবসার ব্যবহার করলে গাছ বেশ স^াস্থ্যবান থাকে। এতে দেশের বন-সংরক্ষণের গতি বেড়ে যায়। এ জৈব ভার্মি সার লাভজনক ব্যবসা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে। সত্যি বলতে কী দূষিত পরিবেশ থেকে সবুজ পরিবেশ তৈরি করার এ প্রয়াস এক ধরনের অসাধারণ এবং অভিনব পদ্ধতি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট