মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। মানব দেহে ৬৫ শতাংশ অক্সিজেন থাকে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্লুকোজ থেকে কোষে শক্তির সঞ্চার হয়। আসলে আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন দরকার। যখন আমরা বাতাস থেকে শ্বাস নিই তখন অক্সিজেনের অণুকণাগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং তা আমাদের ফুসফুসের প্রকোষ্ঠের মধ্য দিয়ে রক্তে অতিবাহিত হয়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, অক্সিজেনের প্রাথমিক উৎস হলো গাছগাছালি।
দুঃখজনক হলেও সত্য, নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। অথচ অক্সিজেন নির্ভরশীল মানুষ কি বেমালুম ভুলে গেছে, অক্সিজেনের কারখানা বলে অভিহিত সেই গাছপালার কথা? প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমরা মানুষেরাই সেই গাছপালা নিধন করে চলেছি। বুঝেও কেন বুঝছি না যে, গাছপালা না থাকলে, আমরাও এই বিশ্বে টিকে থাকতে পারব না। ইতোমধ্যে স্থূলভাবে বোঝা না গেলেও সূক্ষ্মভাবে অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মাণ হয়, বন-বনানী হ্রাস পাওয়ার কারণে আমরা হয়তো অক্সিজেনের অভাবে বিপদের মুখোমুখি হতে শুরু করেছি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, আমরা ছোটবেলায় বিভিন্ন জনপদে আপনা থেকেই বেড়ে ওঠা কত গাছপালা ও ঝোপঝাড় দেখেছি। এখন সেরকম আর পরিলক্ষিত হয় না। সহজ কথায় বলতে পারি, জীবকুলের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান মানুষ নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে। এটা সত্য, প্রকৃতি সব সময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে প্রকৃতি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। আর বলতে গেলে আমরা সেরকম নেতিবাচক অবস্থার মুখোমুখি হতে শুরু করেছি।
বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বলা হয়েছে, একটি মাত্র পূর্ণবয়স্ক সুস্থ-সবুজ পাতাযুক্ত গাছ ১০ জন মানুষের এক বছরের অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে এবং ৪৮ পাউন্ড কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে দুজন মানুষের অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দিতে পারে। একটি যাত্রীবাহী বাস ২৬ হাজার মাইল পথ চালানোর পর যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়ে; এর বিপরীতে এক একর বনভূমির গাছ সেই পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করতে পারে। এদিকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক প্রতিদিন ৫৫০ লিটার অক্সিজেন গ্রহণ করে। আর গড়আয়ু ৭০ বছর হলে সব মিলিয়ে ১৪ লাখ ৬ হাজার ২৫০ লিটার অক্সিজেনের আবশ্যক হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই পরিমাণ অক্সিজেন তৈরি করে পূর্ণবয়স্ক মাত্র ১৭টি গাছ। এ ধরনের একটি গাছ বছরে প্রায় ১১৮ কেজি অক্সিজেন দিয়ে থাকে। শুনে হয়তো আশ্চর্য হবেন, অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী, নিম গাছ, স্নেইকপ্লান্ট, পিপল গাছ, অর্কিড গাছ রাতে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন দেয়। সেহেতু অ্যালোভেরা বাড়ির ছাদ-আঙিনা এবং অর্কিড গাছ বিছানার পাশে রাখা সমীচীন। এদিকে নিম গাছ যেখানে থাকে, সেখানে শিশুদের শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি রোগ তুলনামূলক কম হয়। তুলসী শুধু ২৪ ঘণ্টা ধরে অক্সিজেন সরবরাহ করে না এবং একই সঙ্গে পরিবেশকে শুদ্ধ রাখতে সহায়তা করে। তা ছাড়া বাঁশ, পাইন, বট গাছ ইত্যাদি প্রচুর অক্সিজেন দিয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে এ ক্ষেত্রে যদি বাঁশ গাছের কথা বিবেচনা করি, তাহলে দেখি যে বাঁশবন ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ বেশি অক্সিজেন ছাড়ে এবং একই সঙ্গে পাঁচ থেকে ছয় গুণের বেশি কার্বন শোষণ করে থাকে। মরুভূমির দেশ সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বের অনেক দেশে নিম গাছ রোপণ করার কারণে অক্সিজেন বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
বিশ্বে বনভূমির পরিমাণ ৮.৬০ বিলিয়ন হেক্টর। সেই হিসাবে বিশ্বের মোট ভূমির ৩০.৪ শতাংশ বনভূমি। এদিকে জাতিসংঘ বলেছে, বনভূমি বিশ্বে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৪ মিলিয়ন হেক্টর বা ১৫ মিলিয়ন বর্গমাইল। সুদূর প্রাচীনকালে পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমি অনাবৃত বা খালি ছিল বলে বন-বনানীতে ভরা ছিল। কিন্তু মানুষের বন বিধ্বংসী কার্যকলাপে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১৩ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি নষ্ট বা ধ্বংস হচ্ছে। আর এভাবে লাগাতার বনভূমি নষ্ট করার কারণে বিশ্বসভ্যতার স্বর্ণশিখরে এসেও পরিবেশদূষণের কারণে মানুষসহ জীবজগৎ নিজেদের স্থায়িত্ব নিয়ে দিশাহারা। অধুনা বিজ্ঞানের বদৌলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ জলে, স্থলে ও মহাশূন্যে আধিপত্য বিস্তার করলেও বনসম্পদ রক্ষায় মানুষ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য, বনভূমি আবহাওয়াকে আর্দ্র রাখে এবং সময়মতো বৃষ্টিপাত হওয়ার সুবাদে কাম্যফসল উৎপাদনের পথ সুগম করে। অথচ বনভূমি ধ্বংস হওয়ায় অনাবৃষ্টি, ভূমিধস, ভূগর্ভের পানির স্তর সীমাহীনভাবে নিচে নেমে চলছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু বায়ুমণ্ডল উষ্ণ নয়। একই সঙ্গে মেরু অঞ্চলসহ পর্বতমালার বরফ গলে সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাচ্ছে বিধায় উপকূল অঞ্চলে লবণাক্ত পানি ঢুকে আর তেমন ফসল জন্মাতে পারছে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক