ফিলিস্তিন। এক বিধ্বস্ত জনপদের নাম। যেখানে প্রায় পৌনে শতাব্দী যাবৎ মানবতার ভয়াল বিপর্যয় ঘটছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া অবৈধ দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েল তার মিত্রদের প্রত্যক্ষ মদতে মসজিদুল আকসাকে বুকে আগলে রাখা ফিলিস্তিনে বর্বরতা চালাচ্ছে। ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে এই বর্বরতা ও হিংস্রতা যারপরনাই গতিতে বেড়ে চলছে। প্রায় ৭০ হাজার নিরস্ত্র বেসামরিক লোককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। যার সিংহভাগই নিষ্পাপ শিশু, অসহায় বৃদ্ধ ও নারী।
১৯৪৮ সালের পর ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করার মাধ্যমে মসজিদুল আকসার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। মসজিদুল আকসা, যা শুধু ফিলিস্তিনের নয়, বরং পুরা মুসলিম বিশ্বের জন্য অত্যন্ত সম্মানিত একটি স্থান, তার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ইসরায়েলি বাহিনী বারবার হামলা চালিয়েছে এবং মুসলমানদের ওপর এ সহিংসতা অব্যাহত রেখেছে। এটি শুধু ভূখণ্ডের জন্য নয়, বরং মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস, স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার জন্যও এক গভীর সংকট। এ পরিস্থিতিতে মুসলিম হিসেবে আমাদের কিছু দায়িত্ব তুলে ধরা হলোÑ ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য দোয়া করা আমাদের আধ্যাত্মিক সংহতির অন্যতম প্রধান মাধ্যম। রসুল বলেছেন : ‘দোয়া হচ্ছে মুমিনের অস্ত্র (তিরমিজি)।’ এ হাদিসের আলোকে আমরা বুঝতে পারি, দোয়া শুধু একটি প্রার্থনা নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা আল্লাহর কাছে আমাদের আবেগ, বেদনা ও আশার প্রতিফলন। ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণের জন্য আমাদের অবিরাম দোয়া করা উচিত। তাদের ধৈর্য, সাহস ও বিজয়ের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা উচিত।
ফিলিস্তিনের গণহত্যা ও সংকট সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রচার করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। গণমাধ্যমের অপপ্রচার ও ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া জরুরি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে ফিলিস্তিনের সত্য ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা আমাদের জন্য আবশ্যক। মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং প্রকৃত সত্য সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা শুধু একটি নৈতিক কর্তব্য নয়, বরং এটি মানবতার পক্ষে যুদ্ধও বটে। ফিলিস্তিনের সংগ্রাম ও নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা তাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে পারি। সঠিক তথ্য প্রচার করে আমরা ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণের পাশে দাঁড়াতে পারি এবং তাদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে বিশ্বব্যাপী সমর্থন গড়ে তুলতে পারি।
ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠানোর ব্যবস্থা করা আমাদের মানবিক ও ধর্মীয় কর্তব্য। ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণ দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ ও নির্যাতিত জীবনযাপন করছে। তাদের অর্থনৈতিক সংকট ও মানবিক দুর্দশা লাঘব করতে আমাদের সাধ্যমতো সাহায্য করা উচিত। নির্ভরযোগ্য সংস্থার মাধ্যমে তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। মানবিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আমরা ফিলিস্তিনের মানুষের দুর্দশা লাঘব করতে পারি এবং তাদের সংগ্রামে শক্তি জোগাতে পারি। ইসরায়েলি পণ্য এবং তাদের অর্থায়নে পরিচালিত কোম্পানির পণ্য বর্জন করা আমাদের একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রতিরোধ কৌশল। এ বর্জন নীতি শুধু একটি প্রতিবাদ নয়, বরং এটি ইসরায়েলের অর্থনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার একটি কার্যকরী হাতিয়ার। ইসরায়েলি পণ্য বর্জন করে আমরা তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারি, যা তাদের অত্যাচার ও দখলদারত্বের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে। এটি বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জোরদার করে এবং ইসরায়েলের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠায়। ফিলিস্তিনের প্রকৃত ইতিহাস ও আল-আকসার গুরুত্ব সম্পর্কে জানা এবং অন্যদের জানানো আমাদের অপরিহার্য দায়িত্ব। ফিলিস্তিনের ইতিহাস শুধু একটি ভূখণ্ডের গল্প নয়; এটি ইসলামি ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও ন্যায়ের প্রতীক। আল-আকসা মসজিদ ইসলামের প্রথম কিবলা এবং তিনটি পবিত্র মসজিদের একটি, যা মুসলিমদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত। ফিলিস্তিনের ইতিহাস জানা আমাদের তাদের সংগ্রামের প্রকৃত চিত্র বুঝতে সাহায্য করে এবং তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও মসজিদে ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন করা আমাদের কর্তব্য। ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে আমরা একটি সচেতন ও সংবেদনশীল প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারি। ফিলিস্তিনের গণহত্যা ও দীর্ঘস্থায়ী সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর