চলমান অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে দেশের বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টস অনুযায়ী, জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে নিট এফডিআই এসেছে মাত্র ৯১ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ১২৭ কোটি ডলার, অর্থাৎ এক বছরে প্রায় ৩৬ কোটি ডলারের ঘাটতি।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এই খাতে এলসি খোলা হয়েছে ১৪১ কোটি ডলারের, যেখানে আগের অর্থবছরে ছিল ১৯৫ কোটি ডলার, কমেছে প্রায় ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এলসি নিষ্পত্তি কমার হার ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা দেশের নতুন শিল্প স্থাপনা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক সংকেত। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র আন্দোলন-পরবর্তী সময় থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছিল, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে জুলাই-সেপ্টেম্বর মেয়াদে এফডিআই প্রবাহে। ওই সময়ের এফডিআই দাঁড়ায় মাত্র ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, যা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ছিল সবচেয়ে কম। অক্টোবরে কিছুটা স্থিতি ফিরলে অক্টোবর-ডিসেম্বরে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯ কোটি ৪ লাখ ডলারে। তবে জানুয়ারি-মার্চে আবার তা ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ কমে নামে ২৬ কোটি ৬২ লাখে।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর নির্ভর করেই দেশে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপিত হয়, যা কর্মসংস্থান তৈরি করে। কিন্তু বর্তমানে নতুন শিল্প স্থাপনার গতি শ্লথ হওয়ায় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বিদেশিরা তখনই বিনিয়োগ করেন, যখন দেশীয় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসেন। কিন্তু বর্তমানে দেশীয় উদ্যোক্তারা বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে, তাই বিদেশিরা আসছেন না।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানও এই ধীরগতির প্রমাণ দেয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যেখানে আগের বছর এই হার ছিল ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
তবে আশার কথা হলো, অক্টোবর-এপ্রিল সময়ে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের নতুন বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বেজা ও বেপজা। বিডা এক বিবৃতিতে জানায়, এ সময়ে তারা ৭৩৯টি নতুন শিল্প প্রকল্প নিবন্ধন করেছে, যার মধ্যে ৬৬টি সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানায় এবং ৬১টি যৌথ উদ্যোগে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লেখেন, বিনিয়োগ আসে ধীরে ধীরে। কোনো সামিটে গিয়ে কেউ আবেগে ১০০ কোটি টাকার চেক লিখে দেন না। তবে আমাদের বিনিয়োগ পাইপলাইন এখন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।
সব মিলিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিগত সংস্কার ছাড়া বিনিয়োগে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সম্ভব নয় বলে মত বিশ্লেষকদের। এখন প্রয়োজন, দেশীয় বিনিয়োগে আস্থা ফিরিয়ে আনাসহ দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সহায়তা ও প্রকৃত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
বিডি প্রতিদিন/আশিক