দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক সঙ্কট এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশের শিল্পখাত ব্যাপক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে তা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উপর ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন অনেকে।
সাম্প্রতিক সময়ে, দেশের প্রথমসারির বেশ কয়েকজন শিল্পপতি তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন। ব্যবসায়িক নেতারা দাবি করছেন, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে সমন, এমনকি আইনি পদক্ষেপের আড়ালে চাঁদাবাজির হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে খুনসহ মিথ্যা ফৌজদারি অভিযোগ আনার অভিযোগও রয়েছে। যা আতঙ্ককে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এর কারণে বিনিয়োগ পরিকল্পনা বার বার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যও উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই থেকে মার্চ) গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে শিল্পপণ্য আমদানির জন্য ব্যবহৃত ঋণপত্র (এলসি) উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
তথ্য বলছে, টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ ১৬.০৭% কমেছে। সেটেলমেন্ট কমেছে ২১.৬৬%। চামড়া শিল্পের এলসি খোলার পরিমাণও ১৮.১৮% কমেছে। যদিও সেটেলমেন্ট সামান্য বেড়ে ২.৪৬% হয়েছে। ওষুধ শিল্প আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই শিল্পে এলসি খোলার পরিমাণ ২১.৪৪% কমেছে এবং সেটেলমেন্ট ৪২.৫২% কমেছে। প্যাকেজিং উপকরণের এলসি খোলার পরিমাণ ৩৫.৫২% কমেছে। সেটেলমেন্ট ৩৭.৬৯% কমেছে। কাঁচা তুলা আমদানিতে এলসি খোলার পরিমাণ ৯.২৯% কমেছে এবং সেটেলমেন্ট ২.৫৩% কমেছে।
এছাড়া লোহা ও ইস্পাত স্ক্র্যাপ, ক্লিংকার, চুনাপাথর, ট্রাক্টর এবং পাওয়ার টিলারের মতো কৃষি যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের আমদানিও কমেছে আশংকাজনকভাবে।
তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। পাট শিল্পে এলসি খোলার পরিমাণ ৫৩.৮৪% বেড়েছে। যদিও সেটেলমেন্ট ১৪.৫৮% কমেছে। পোশাক খাতও কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা গেছে। এলসি খোলা ২০.৭৪% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেটেলমেন্ট ৫.৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু শিল্প বিনিয়োগের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ অংশ মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত, এই খাতে এলসি খোলা ২৮.৬৮% হ্রাস পেয়েছে। যা ১,৮০৪ মিলিয়ন ডলার থেকে ১,৩৩৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। সেটেলমেন্টও ২৩.৮৬% হ্রাস পেয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২,১৩৩ মিলিয়ন ডলার থেকে ১,৫২১ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি হ্রাসের কারণ হল বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতিও এর পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। এর পাশাপাশি উচ্চ সুদের হার এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যাংক ঋণকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। যা বিনিয়োগকে আরও নিরুৎসাহিত করেছে।
এমন অবস্থায় দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার এবং ব্যবসায়িদের মধ্যে সংলাপের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জটিলতা আরও তীব্র হয়। ভূমি বাণিজ্য হ্রাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক শুল্ক বৃদ্ধি এবং দুর্বল হওয়া বিশ্ব বাজারের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান না হলে গুরুতর পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারে দেশ, এমন সতর্কতা জানিয়েছেন শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা।
এর পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, শিল্প উৎপাদন হ্রাস এবং বৃহত্তর সামাজিক অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে গত রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবেগঘন আবেদন জানান। তিনি বলেন, “যদি ব্যবসায়ীদের আর্তনাদ শোনা না যায়, তাহলে ঈদের পরে আমাদের কারখানাগুলো ত্যাগ করতে হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই দেশে বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি সংস্কার ঘটছে – একটি বিপ্লব চলছে। আমরা সেই বিপ্লবের অন্যতম প্রধান অংশীদার।”
আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা অর্থনীতির চাকা সচল রাখছি। দয়া করে এটি বিবেচনায় নিন। আপনি যদি এই লোকদের বিবেচনা না করেন, তাহলে আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি যে এই দেশ আর কোনও অর্থে একটি দেশ থাকবে না।”
শিল্পখাত ও সরকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্বের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে ভবিষ্যতের পথ তৈরি করতে হবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ থাই চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শামস মাহমুদও একই রকম হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, “যতক্ষণ না ব্যাংকিং খাত তারল্য ফিরে পায় ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও নতুন শিল্প বিনিয়োগ আসবে না,”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “ব্যাংকগুলোকে শিল্প নয় বরং ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের জন্য তারল্য আরও কঠোর করা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আরও কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে বলেন, “জ্বালানি সংকট, ব্যাংক অর্থায়নের অভাব এবং শিল্পায়নের প্রতি সামগ্রিক নীতিগত অবহেলা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নীতিগুলো শিল্প প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।”
ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমানও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “যেখানে আইনশৃঙ্খলা অনিশ্চিত সেখানে কেউ বিনিয়োগ করবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা এবং আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে সরকারকে।”
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম) এর নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি সতর্ক করে বলেছেন যে সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশ দ্রুত অবনতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি ব্যবসার জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল। অনাচার, চাঁদাবাজি, অযৌক্তিক মামলা এবং ব্যবসায়ীদের উপর হামলার ক্রমবর্ধমান ঘটনা কেবল অর্থনীতির ক্ষতি করছে না বরং ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতাকেও বাড়িয়ে তুলছে।”
তিনি সতর্ক করে আরও বলেন, তাৎক্ষণিক এবং সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশ আরও গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন