কী লজ্জা!
কী লজ্জা!
এই পাতাবুনিয়া গ্রাম।
এই জাদুয়ারচর।
অথবা আরও দূরে কোথাও।
কেউ কী জানার বাকি আছে?
গাছে গাছে পাতায় পাতায় ক্যামেরা!
সব দেখে সবাই। আমরাই কত কী মজা করেছি এই ক্যামেরার ভিডিও দেখে।
সেবার সেই বুড়ো দাদুর কী হাল হয়েছিল! কম কী জ্ঞান ধরে তার মাথায়? এক-দুদিন বয়স তার? কেউ বলে ছয় কুড়ি বছর! কেউ বলে নয় কুড়ি বছরেরও ঢের বেশি! চারটেখানি কথা! এত বছরের অভিজ্ঞতা, সব ধুলোয় গড়াগড়ি। তা-ও কি না এক পুঁচকে ছোকড়ার কাছে।
এই ছেলেটাই ছিল সেদিন! বলল লুলু।
এই ছেলেটাই! লুপাই নাম ওর।
বলিস কী? বাপরে! লুপাই কি টুপাই! নাম যাই হোক কী তাই হোক। বলি একটু ভয়-ডর কি থাকতে নেই, নাকি! বলল টুলু।
সেদিন কী ঘটনাটা ঘটল। বুড়ো দাদু ভেবেছিল তাকে একটু ভয়-ডর দেখাবে। কতদিন কাউকে ভয় দেখায় না। বেশ মজা হবে, ভেবে মনে মনে খুশি হলো দাদু।
বাচ্চা ছেলে একটু আধটু এদিক সেদিক করলেই ভয় পাবে? ভয় পাবে আর ও বাবা গো, ও মা গো বলে চিৎকার দিয়ে ছুটে পালাবে। কপাল মন্দ হলে পা পিছলে পড়বে। গড়াগড়ি খাবে। ফের উঠে ছুট লাগাবে। আর বাড়ি গিয়ে বলবে, বড় পুকুরের ধারে...।
চোখ বড় বড় করে সবাই তার কথা শুনবে। আর বড় পুকুর নিয়ে সাত-পাঁচ ভাববে। আরও আরও গল্প হবে।
কিন্তু কাণ্ড কী ঘটল?
এমন কি হয়েছে কখনো?
পুকুরপাড় দিয়ে বাড়ি ফিরছিল লুপাই।
হুট করে সামনে এসে দাঁড়াল বুড়ো দাদু।
খিকখিক করে হাড় কাঁপানো ভূতুড়ে হাসি হাসল। সঙ্গে চেহারাটা এমন করল। বাপরে!
প্রচণ্ড ভয় পাওয়ার কথা তার। ভয় পেয়ে ছুট দেওয়ার কথা। বাবা গো, মা গো বলে চিৎকার করার কথা। কিন্তু ঘটনা তা ঘটল না। গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে লুপাই।
গাছ থেকে অমন লাফিয়ে নেমে খিকখিক হাসলেই ভাবছ ভয় পাব? সন্ধ্যাবেলা কি ভূত চেপেছে মাথায়? দূর হও সামনে থেকে। বলেই দিল এক ধাক্কা। বুড়ো দাদু কি আর টাল সামলাতে পারে! আর যায় কোথায়? ঝুপ্পুস!
ছয় কুড়ি, নয় কুড়ি বছরের সুনাম গড়াগড়ি খেয়ে পুকুরে ডুবল। বিশ-কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা হাবুডুবু খেল পানিতে।
আর জল থেকে কী দেখল বুড়ো দাদু। কিচ্ছু না। সুনসান চারপাশ। আর লুপাই? নেই। কোথাও দেখা গেল না তাকে। এক্কেবারে হাওয়া। এই ছিল আর এই নেই হয়ে গেল! ভাবা যায়!
গতকালকের ঘটনা কী?
লুলু আর টুলুর সঙ্গেই ঘটেছে ঘটনা।
বলা যায় না সেসব। লজ্জার কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে ঘটনা সবাই দেখেছে। দেখবে না, গাছে গাছে ক্যামেরা। পাতায় পাতায় ক্যামেরা। তাই ঘটনা যা ঘটে তা সবাই দেখে। লুলু আর টুলুর ঘটনাও দেখেছে।
পিলে চমকানো সাজেই সেজেছিল লুলু আর টুলু। ভয়ংকর পিলে চমকানো সাজ। কিন্তু পিলে কী চমকালো?
খেলা শেষে বাড়ি ফিরছিল লুপাই। একা। খেলায় হেরেছে। আর খেলায় হারলে মেজাজ তো তিরিক্ষি থাকবেই। মাথায় নানা রকম ভাবনাচিন্তা চলতে থাকে।
মন আনমনা থাকে। এমন কাউকে দেখলে মনে হবে, সে এই দুনিয়ায় নেই।
অন্য জগতে আছে। এমন সময় ভয় দেখালে ভয় পাওয়ার কথা। ভীষণরকম ভয় পাওয়ার কথা!
লুলু টুলুও দেরি করেনি। জারুল গাছে ছমছম শব্দ তুলে, বাতাসে ভয়ের গন্ধ মেখে উল্টো হয়ে লুপাইর নাক বরাবর নেমেছে। নেমেই উনিশবার ঘুরুণ্টি খেয়েছে আর নেমেই মেছো ভূতের মতো দাঁত বের করে পিলে চমকানো হাসি দিয়েছে।
লুপাইর এখন দাঁত কপাটি দিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ার কথা। পিলে চমকানোর কথা। বাবা গো মা গো বলে চিৎকার দেওয়ার কথা।
কিন্তু কই। কিচ্ছুটি হচ্ছে না।
লুপাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজ আরও তিরিক্ষি হয়েছে।
লুলু টুলুর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ লাল হয়ে উঠছে।
হঠাৎ-
বিরাশি ছিক্কা একটা থাপ্পড় দিল লুলুকে
বিরাশি ছিক্কা একটা থাপ্পড় দিল টুলুকে।
মাথা ভন ভন করে উঠল লুলুর
মাথা টনটন করে উঠল টুলুর।
ঘুরুণ্টি খেয়ে পুকুরে পড়ল লুলু আর টুলু।
কে দেখল সেসব?
কে আবার।
গাছে গাছে পাতায় পাতায় ক্যামেরা।
কী লজ্জা! কী লজ্জা!
দুই দিন বাড়ি যায়নি লুলু আর টুলু। ভেবেছিল কাউকে ভয় দেখিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু ওটা কে আসছে! লুপাই।
আজও খেলায় হেরেছে। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ তিরিক্ষি মেজাজ। লুলু আর টুলু কি তাকে আজ ফের ভয় দেখাবে? মাথা নষ্ট।
আর সেদিন মাথা ঘুরুণ্টি খেয়ে কী দেখেছিল লুলু?
কী দেখেছিল টুলু?
কী আবার কিচ্ছু না। সুনসান চারপাশ।
আর লুপাই? এক্কেবারে হাওয়া।
লুপাইটা তবে কে?
লুপাইটা তবে কী?
ভাবতেই কে যেন খিকখিক করে হেসে উঠল। ভয়ংকর পিলে চমকানো হাসি। আবার হাসল। খিকখিক খিকখিক খিকখিক...
কে হাসল?
পাতাবুনিয়া গ্রাম।
জাদুয়ারচর।
কী আরও দূরে। কোথাও দেখা গেল
তাকে!
বাপরে! বলে দৌড় দিল লুলু আর টুলু।