রাজধানীর প্রথম সারির একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র রবিউল ইসলাম (ছদ্মনাম)। স্কুল থেকে ফিরেই মা কিংবা বাবার স্মার্টফোন নিয়ে বসে যায়। বছর দুয়েক ধরে চলছে এভাবে। শত নিষেধ-বারণেও থামছে না।
এ নিয়ে কিছু বললে বা মোবাইল ফোন কেড়ে নিলে সে জেদ করে—খাবে না, পড়বে না। এমনকি আজকাল প্রায়ই নিজের একটি স্মার্টফোনের জন্য ঘ্যানঘ্যান করছে।
অথচ স্মার্টফোনে আসক্তির আগে এই রবিউল স্কুল থেকে ফিরে ক্লাসের বিভিন্ন বিষয়ে বলত মা-বাবাকে। মা-বাবার মধুর সান্নিধ্যে তখন কেটে যেত সময়।
শুধু রবিউলের নয়, রাজধানীসহ সারা দেশে অনেক শিশু স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ—এসব প্রযুক্তিগত ডিভাইস ব্যবহারে আসক্ত। অভিভাবকের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অনেকে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত চষে বেড়াচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবে শিশুদের মনোজগতে ভার্চুয়াল থাবা তাদের কোমলতা নষ্ট করছে। অকালে অনেক শিশুর মন হয়ে উঠছে অপরাধপ্রবণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ডিভাইসে থাকা বিভিন্ন অ্যাপ শিশুদের শিক্ষা ও প্রযুক্তি জ্ঞানের দিক দিয়ে উপকার করলেও এসবের অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের মেধা ও সুস্থ সামাজিক বিকাশে ভয়ানক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কিছু শিশু মা-বাবার লগ ইন করা ফেসবুক ঘাঁটছে। এতে অনেক সময় আপত্তিকর বা বিব্রতকর কনটেন্টও সামনে চলে আসছে। এসব কনটেন্ট শিশুর মনোজগতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বড়রাও অনেকে অপ্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করছেন ভার্চুয়াল জগতে। রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী এনামুল হক (ছদ্মনাম) বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া বা ফেসবুক দিনের অনেকটা সময় কেড়ে নেওয়ায় বন্ধু-বান্ধব বা স্বজনদের সঙ্গে আগের মতো মেশা হচ্ছে না। এ থেকে কেন জানি বের হতে পারছি না।’
বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু-কিশোররা। গত পাঁচ-ছয় বছরে দেশে সাইবার অপরাধের শিকার শিশুর সংখ্যা বেড়েছে দেড় গুণের বেশি। ২০২৩ সালের মে মাসে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধপ্রবণতা ২০২৩’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে সাইবার অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪.৮২ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। মূলত ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে শিশু ।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছ, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং সাইবার ওয়ার্ল্ড নিরাপদ রাখতে দেশে অনেক আইন রয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সর্বদা কাজ করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘সাইবার অপরাধের ব্যাপারে আমরা সব সময় তৎপর আছি। সাইবার অপরাধ নিয়ে কোনো অভিযোগ জমা পড়লে অতি দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিশেষ করে শিশুদের আমরা আলাদা গুরুত্ব দিয়ে থাকি।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, দৃষ্টিশক্তি কমে, মাথা ব্যথা হয়। এ ছাড়া সামাজিকতা রক্ষার বিষয়টি কমে যায়, মানসিক চাপ তৈরি হয়। একই সঙ্গে আরো কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে প্রায় ৭২ শতাংশ শিশু দিনে তিন ঘণ্টার বেশি সময় মোবাইল ফোন বা ট্যাবের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডুবে থাকে।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বর্তমানে অনেক মা-বাবা তাঁদের শিশুসন্তানকে শান্ত রাখতে স্মার্টফোনে কার্টুন ছবিসহ বিভিন্ন ভিডিও বের করে দেখতে দেন। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। এভাবে সমাজে বেশির ভাগ পরিবারের শিশুদের মধ্যে প্রযুক্তি উপভোগ করার অভ্যাস গড়ে উঠছে। এ ছাড়া অভিভাবকের অগোচরে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তির অপব্যবহারে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সাইবার অপরাধ ও ফেসবুকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে অনেক শিশু-কিশোর। এসবের জেরে উঠতি বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এভাবে প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে সমাজে। তবে এ থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কিছু কনটেন্টে ফিল্টার করা জরুরি। এ ছাড়া অভিভাবকদেরও এ বিষয়ে সচেতন হওয়াটা জরুরি।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/কেএ