ট্রেনের জানালার বাইরে ঝুলে রয়েছেন এক ব্যক্তি। ভেতর থেকে কেউ তার হাত ধরে রেখেছেন। প্রাণে বাঁচার জন্য আর্তনাদ করছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে ভেতর থেকে হাত ছেড়ে দিলে লোকটিকে ট্রেনের নিচে পড়ে যেতে দেখা যায়। এ ঘটনার ৩৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে গত রবিবার বেলা ১টার দিকে বগুড়ার আদমদীঘির নসরতপুর রেলস্টেশন এলাকায়।
ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তির নাম মতিউর রহমান (৪৫)। তিনি নওগাঁর রানীনগর উপজেলার পাড়ইল গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় বগুড়ায় একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মতিউর পেশায় একজন অটোরিকশা চালক ছিলেন। দুই বছর ধরে এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর কাজ করছেন। ২০ দিন আগে বগুড়ার আদমদিঘীর তালশান গ্রামের মোহাম্মদ হেলালের ছেলে সজীব হোসেনকে সাড়ে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। সৌদি আরবে গিয়ে সজীবের বৈধ কাগজপত্র পেতে দেরি হওয়ায় তার পরিবারের সদস্যরা সাত থেকে আট দিন আগে মতিউরের বাড়িতে গিয়ে কাগজপত্রের বিষয়ে জানতে চায়। এ নিয়ে সেখানে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এরই জের ধরে গতকাল রবিবার দুপুর ১টার দিকে বগুড়া থেকে ট্রেনে মতিউরকে একা পেয়ে সজীবের ছোট ভাই রাকিব ও সজীবের শ্যালকরা মিলে মোবাইল চোর ও ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
মতিউর রহমানের ছেলে আহসান হাবিব বলেন, আমার বাবা পেশায় একজন অটোরিকশা চালক ছিলেন। গত দেড় থেকে দুই বছর থেকে সৌদি আরবের অ্যাম্বাসির মাধ্যমে লোক পাঠানোর কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত তিন থেকে চারজনকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। তারা সে দেশে ভালো আছে। গত ২০ দিন আগে আমার বাবা বগুড়ার আদমদিঘীর তালশন গ্রামের মোহাম্মদ হেলালের ছেলে সজিব হোসেনকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। সৌদি আরবে পাঠানো বাবদ তার কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে যেয়ে বৈধ কাগজপত্র পেতে দেরি হওয়ায় সজিব তার বাবাকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে গত সাত থেকে আট দিন আগে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি দিয়ে যায়। এরই জের ধরে গতকাল রবিবার বগুড়া থেকে দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস ট্রেনে বাড়িতে ফেরার পথে সজিবের ছোট ভাই রাকিব ও সজীবের শ্যালকরা আমার বাবাকে মোবাইল চোর বলে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বাবা খুব কষ্ট করে প্রায় চার থেকে পাঁচ মিনিট ট্রেনের সঙ্গে ঝুলে ছিল। বাবার কাছে ব্যবসায়িক কাজের ৫০ হাজার টাকা ছিল সেটিও তারা কেড়ে নেয়। একপর্যায়ে ট্রেনটি আদমদিঘী উপজেলার নশরৎপুর স্টেশনে এলে সেখানকার প্লাটফর্মের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আমার বাবা ট্রেনের নিচে পড়ে যান। ট্রেনের নিচে পড়লেও বাবা কোনোরকম প্রাণে বেঁচে যান এবং এক পা ভেঙে যায়। বাবাকে উদ্ধার করে প্রথমে আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর এখন বগুড়ায় একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন।
এ ঘটনায় কেউ মামলা নিচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি।
আহসান হাবিব বলেন, আদমদীঘি থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ সান্তাহার জিআরপি পুলিশ স্টেশনে যোগাযোগ করতে বলেন। সান্তাহার জিআরপি পুলিশ স্টেশনে গেলে সেখানেও কোনো মামলা নেওয়া হয়নি।
ট্রেন থেকে মতিউরকে ফেলে দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সৌদি প্রবাসী সজিবের চাচা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার ভাতিজা সজিব মতিউরের মাধ্যমে সৌদিতে গেছে। কিন্তু মতিউর আমার ভাতিজার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সৌদিতে যে কোম্পানিতে কাজ করার জন্য পাঠাইছে তারা এখনো আকামা দেয়নি। কিন্তু মতিউর আমার ভাতিজাকে আকামা পাইয়ে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখনো আকামা দেওয়ার কথা বলে নানা তালবাহানা করছে। এটা নিয়ে মতিউরের সঙ্গে আমাদের বিরোধ চলছে।
অভিযোগের বিষয়ে সজীবের বাবা মোহাম্মদ হেলাল বলেন, এক মাস আগে বড় ছেলে সজীবকে মতিউরের মাধ্যমে চার লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত মতিউর আমার ছেলেকে কোনো কাজ দিতে পারেনি। এ নিয়ে তার সঙ্গে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছি। তিনি আমার সঙ্গে দেখা না করে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। ট্রেনে কী হয়েছে আমি কিছু বলতে পারব না।
নওগাঁর রাণীনগরের পারইল গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের একই গ্রামে বাড়ি। মতিউর গত দেড় থেকে দুই বছর যাবৎ বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করছে। কখনো তাকে কোনো ঝামেলায় পড়তে দেখিনি।
আদমদিঘী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি রেলওয়ে পুলিশের বিষয়, তাই আমরা কোনো অভিযোগ নেইনি।
সান্তাহার রেলওয়ে থানা পুলিশের পরিদর্শক (ওসি জিআরপি) মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, তারা প্রথমে আদমদিঘী থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিল। সেখানে তাদেরকে জিআরপিতে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে। তখন তারা আমার থানায় এসেছিল। আসার পরে তাদেরকে নাকি আবার আদমদীঘি থানা থেকে ফোন করা হয় তখন তারা আবারও আদমদিঘী থানায় অভিযোগ জানাতে চলে যায়। পরে তারা আর আমার থানায় আসেনি। আমরা সবসময় অভিযোগ এবং তদন্তসাপেক্ষে মামলা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ