নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল থেকে মেঘনা সেতু পর্যন্ত তিনটি স্থানে পরিবহন খাতে ব্যাপক চাঁদাবাজি চলছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এই তিনটি স্থান হলো শিমরাইল মোড়, সাইনবোর্ড এলাকা ও সোনারগাঁওয়ের কাঁচপুর মোড়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর কয়েক মাস পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ থাকলেও ফের চাঁদাবাজরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ ওই তিন স্থানে প্রতি মাসে দুই কোটি টাকা চাঁদা তুলছে চাঁদাবাজরা। স্থানীয় প্রশাসন যদিও পরিবহন চাঁদাবাজদের ছাড় না দেওয়ার কথা বলছে, বাস্তবে এ ব্যাপারে এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যায়। এতে যানবাহনের চালকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। সম্প্রতি ওই মহাসড়কের শিমরাইল মোড়, সাইনবোর্ড ও কাঁচপুরে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজরা। মদনপুর, মোগড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড ও মেঘনা সেতু এলাকায়ও পরিবহন থেকে অবাধে চাঁদা তুলছে একটি চক্র। এ ছাড়া দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে থ্রি-হুইলার, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নসিমন-করিমন চলাচল বন্ধ ঘোষণার পরও মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব অবৈধ যান। ফলে এতে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
সড়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশের নির্লিপ্ততা এবং কার্যকর তদারকির অভাবে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। নিয়মিত চাঁদা দিয়েই সড়কে চলছে এসব ঝুঁকিপূর্ণ যান। মহাসড়কের দুই লেনেই উল্টো পথে চলছে তিন চাকার যান। এ কারণে বেশির ভাগ সময় বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরিসহ বড় গাড়িগুলোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রাণ দিতে হচ্ছে চালকসহ যাত্রীদের।
চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি মহাসড়কের কাঁচপুর সেতুর পশ্চিম পাশে যাত্রীবাহী বাস ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে অটোরিকশার যাত্রী নারী-শিশুসহ তিনজন নিহত হয়। মহাসড়কে চলাচলরত থ্রি-হুইলারকে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ চিহ্নিত করে আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের আগস্ট থেকে স্থায়ীভাবে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। ওই নিষেধাজ্ঞায় প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে প্রায় আট বছর মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল অনেকটাই বন্ধ ছিল। এখন আবার চাঁদার বিনিময়ে এসব অবৈধ যান নিয়মিত চলাচল করছে।
অভিযোগ রয়েছে, আড়াইহাজার এলাকার বাসিন্দা একসময়ের সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক মিজানুর রহমান মিজান ও হাসমত আলী নামের দুই ব্যক্তি মহাসড়কে চলাচলের জন্য প্রতি অটোরিকশা থেকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা নিচ্ছেন। এই টাকার ভাগ হাইওয়ে পুলিশও পায়। মিজান ওরফে ‘সিএনজি মিজান’ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আমলে দলের নাম ভাঙিয়ে এসব চাঁদা তুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিনে গত মঙ্গলবার মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মহাসড়কের একাংশ দখল করে যত্রতত্র যাত্রী তোলা ও নামানোর কাজ চলছে। এতে মহাসড়কে যানজট লেগে আছে। ঠিকানা পরিবহনের সুপারভাইজার আলমাছ মিয়া বলেন, ‘সাইনবোর্ড এলাকা থেকে সাভার পর্যন্ত প্রতিদিন ১৭০টি বাস চলাচল করে এই সড়কে। প্রতিটি পরিবহন থেকে প্রতিদিন এক হাজার ১০০ টাকা করে চাঁদা (জিপি) তোলা হয়।’
অনাবিল পরিবহনের দায়িত্বে থাকা লাইনম্যান সোহরাব হোসেন বলেন, ‘সাইনবোর্ড থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০টি গাড়ি চলাচল করে। আমাদের পরিবহন থেকে রাস্তার খরচ বাবদ ৭০০ টাকা চাঁদা (জিপি) আদায় করা হয়।’ লাব্বাইক পরিবহনের চালক শুক্কুর আলীর ভাষ্য, সাইনবোর্ড এলাকা থেকে ঢাকার সাভার পর্যন্ত প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি গাড়ি চলাচল করে। এসব পরিবহন থেকে প্রতিদিন ৭০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়।
শিমরাইল মোড় এলাকায় একই দৃশ্য চোখে পড়ে। স্থানীয় প্রশাসন এসব পরিবহন মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সোলাইমান নামের মালিক সমিতির নেতার ভাষ্য, ‘আবদুল্লাহপুর কামারপাড়া এলাকায় প্রতিদিন প্রতিটি পরিবহন থেকে এক হাজার ৮৬০ টাকা, শিমরাইল মোড় বাসস্ট্যান্ড থেকে ৭০ টাকা ও একই স্থানের বালুর মাঠ এলাকায় গাড়ি রাখার জন্য ৩০ টাকা এবং গুলিস্তান এলাকায় ৯০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এতে আমাদের প্রতিদিন দুই হাজার টাকার বেশি চাঁদা গুনতে হয়।’
নীলাচল পরিবহনের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তির তথ্য মতে, চিটাগাং রোড থেকে মানিকগঞ্জ পাটুরিয়া পর্যন্ত প্রতিদিন ১২০টি গাড়ি চলাচল করে। এসব গাড়ি থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। শিমরাইল মোড় থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত বৈধ অনুমোদনহীন লক্কড়ঝক্কড় লেগুনা চলছে। এসব লেগুনার বেশির ভাগ চালকের প্রশিক্ষণ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।
লেগুনাচালক সুমন মিয়ার ভাষ্য, ‘অনিক, ইমরান ও শাকিল নামের তিনজন আমাদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৭০ টাকা করে চাঁদা নেয়। শিমরাইল এলাকায় পরশ মিয়া নামের এক ব্যক্তি প্রতিদিন ৩০ টাকা করে চাঁদা তোলে। এ ছাড়া প্রতি মাসে শিমরাইল থেকে এক হাজার ও যাত্রাবাড়ী থেকে এক হাজার টাকা করে হাইওয়ে পুলিশের নামে তোলে পরশ মিয়া।’ কাঁচপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে একই দৃশ্য চোখে পড়ে। কাঁচপুর থেকে গাউছিয়া পর্যন্ত শতাধিক লেগুনা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। বেশির ভাগের বৈধ অনুমোদন নেই। এক লেগুনাচালক বলেন, ‘আমরা সাবেক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতা ও হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব লেগুনা চালিয়েছি।’
আইয়ুব আলী মুন্সী নামের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ট্রাক টার্মিনাল দখল করে চাঁদাবাজি করছেন। তবে আইয়ুব আলী মুন্সী বলেন, ‘শ্রমিক ও মালিকদের কল্যাণের স্বার্থে কাজ করছি। এখানে নাইটগার্ড ও অন্য শ্রমিকদের বেতন ছাড়া কোনো চাঁদার টাকা তোলা হয় না।’ এদিকে হোমনা, সাচার, কসবা, কচুয়াসহ বিভিন্ন পরিবহন থেকে প্রতিদিন ১০০ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করছেন হেলাল মিয়া।
নিউ বেকার পরিবহনের চালক রাজীব মিয়ার ভাষ্য, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ও পুনর্বাসন সোসাইটির কেন্দ্রীয় যুব কমান্ডের সভাপতি শফি আলম চৌধুরী সাগর আওয়ামী লীগের আমলে বিভিন্ন পরিবহন থেকে চাঁদা তুলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাগর স্থানীয় বিএনপি নেতাদের নাম ভাঙিয়ে আগের মতো চাঁদাবাজি শুরু করেন। আমরা টাকা দিতে অস্বীকার করায় আমাদের মেরে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোনসহ গাড়ির কাগজপত্র ছিনিয়ে নেন। এ ঘটনায় শফি আলম সাগর চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পুলিশ।’
একাধিক পরিবহন চালকের ভাষ্য, গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর দুই-তিন মাস চাঁদা নেওয়া বন্ধ থাকলেও গত কয়েক মাস ধরে চাঁদার ধরন বদলে জিপি আদায়ের নামে আবার চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। আগের চেয়ে কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও তিন গুণ হারে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। আমরা চাঁদাবাজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। লেগুনা পরিবহনের যাত্রী আবুল কাসেম বলেন, প্রতিদিন যাত্রাবাড়ীতে অফিসে যেতে লেগুনায় চড়তে হয়। বেশির ভাগ গাড়ির শুধু স্টিয়ারিং ছাড়া বাকি সব ভাঙাচোরা। রুট পারমিট না থাকলেও মহাসড়কে এসব ভাঙাচোরা যান কিভাবে চলছে- এটাই প্রশ্ন।
গ্রিন লাইন পরিবহনের চালক আকরাম উদ্দিন বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড হয়ে মোগড়াপাড়া মেঘনা পর্যন্ত যেতে বেশ ভয়ে থাকি। এখানে বেশির ভাগ গাড়ির ফিটনেস নেই। কখন যে এসব গাড়ির সঙ্গে লেগে দুর্ঘটনা ঘটে!
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেন জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, শিমরাইল মোড় থেকে মেঘনা পর্যন্ত যেসব ফিটনেস-রোড পারমিটবিহীন পরিবহন চলছে, শিগগিরই এসব পরিবহন মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গাজীপুর রিজিয়নের হাইওয়ে পুলিশ সুপার ড. আক্তারুজ্জামান বসুনিয়া জানান, মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন ও রুট পারমিট ছাড়া চলাচল করা যানবাহনের বিরুদ্ধে খুব শিগগির অভিযানে নামবে হাইওয়ে পুলিশ।
র্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘পরিবহন চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে আমরা মাঠে কাজ করছি।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা জানান, এসব অবৈধ পরিবহনের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও চাঁদাবাজদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
সূত্র- কালের কণ্ঠ।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ