বুড়িগঙ্গা দীর্ঘদিন ধরে দূষণে ধুঁকছে। রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটির এই দুরবস্থা যেন বারোমাসি দুঃখিনীর মতো। মাসের পর মাস যায়, বছর ঘুরে আসে, কিন্তু নদীর কালো জল রং বদলায় না। ভরা বর্ষায়ও নদীর দূষণ সেভাবে কমে না। শুকনা মৌসুমে নোংরা জলে ভয়ানক দুর্গন্ধ ছোটে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) করা এক গবেষণায় বুড়িগঙ্গার ঋতুভিত্তিক দূষণের চিত্র উঠে এসেছে।
২০২২-২৩ সালে ছয় মৌসুম বা ১২ মাস ধরে নদীর আটটি স্থানের ১০টি মানদণ্ড পর্যবেক্ষণ করে ক্যাপস। গবেষণার জন্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় মিরপুর ব্রিজ, বছিলা ব্রিজ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীর চর, চাঁদনীঘাট, সদরঘাট, ধোলাইখাল ও পোস্তগোলা ব্রিজ থেকে।
মানদণ্ড ছিল পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন, জৈব রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা, দৃশ্যমানতা, বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা, তাপমাত্রা, অম্লত্ব বা পিএইচ, পানির ঘোলাটে ভাব, ক্ষারত্ব, অদ্রবণীয় ক্ষুদ্র কঠিন পদার্থ (টিএসএস) ও মোট দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ বা টিডিএস। পরে গবেষণাগারে প্রাপ্ত উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। প্রাপ্ত ফলাফলকে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ২০২৩-এ উল্লেখিত জাতীয় আদর্শ মানমাত্রার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে ক্যাপস বলছে, বেশির ভাগ মানদণ্ডের ক্ষেত্রে বসন্ত ঋতুতে পর্যবেক্ষণ করা মানগুলো খুবই উদ্বেগজনক ছিল। অন্যদিকে পানির গুণমান বিবেচনায় বর্ষা ঋতু ছিল সেরা সময়। বিভিন্ন মানবসৃষ্ট কার্যকলাপ (প্রধানত পয়োনিষ্কাশন এবং শিল্পবর্জ্য নিষ্কাশন) এবং শুষ্ক ঋতুতে বৃষ্টির অভাবই উচ্চমাত্রার দূষণের কারণ হতে পারে বলে মনে করছে ক্যাপস।
এমন পরিস্থিতিতে আজ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস পালিত হয়। দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের নেতৃত্বে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) ১৫ সদস্যের একটি গবেষকদল গবেষণাটি পরিচালনা করে।
এ বিষয়ে কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা তার খরস্রোতা রূপ হারিয়েছে নব্বইয়ের দশকেই। এখন বুড়িগঙ্গা পরিণত হয়েছে দূষণের নদীতে। পরিশোধন ছাড়া পয়ঃপ্রণালীর বর্জ্য নদীতে ছেড়ে দেওয়া এবং কারখানার বর্জ্যসহ নানা কারণে প্রতিনিয়ত নদীদূষণ হচ্ছে। আমরা এই গবেষণার মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা নদীর ছয় মৌসুমের আটটি স্থানের পানির গুণগত মান মূল্যায়ন ও তুলনা করে দূষণের চরিত্র বুঝতে চেয়েছি।’
৮ মাস অক্সিজেনের ঘাটতি : জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য পানিতে কী পরিমাণ দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিজলভড অক্সিজেন—ডিও) আছে, তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। জলাভূমিতে জীব বা অণুজীবের জীবনধারনের জন্য প্রতি লিটারে নূন্যতম পাঁচ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রয়োজন হয়।
ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, ছয় ঋতুতে বুড়িগঙ্গা নদীর আট স্থানে গড় দ্রবীভূত অক্সিজেন পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে ৩.০১ মিলিগ্রাম। কেবল বর্ষা (৬.৫৫ মিলিগ্রাম/লিটার) ও শরৎকালেই (৬ মিলিগ্রাম/লিটার) প্রাণধারণের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাওয়া গেছে। সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে শীতকালে, ০.৬৩ মিলিগ্রাম।
বর্ষা ও শরৎকালে বুড়িগঙ্গার পানিতে বৃষ্টির পানি মিশে দূষণের পরিমাণকে কমিয়ে আনে। এই দুই ঋতুতে পর্যাপ্ত আলোর উপস্থিতিতে জলজ প্রাণী পানিতে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন তৈরি করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে। এ ছাড়া এ সময় নদীতে পানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকার কারণেও অক্সিজেন বাড়ে।
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ২০২৩ অনুযায়ী, মৎস্য চাষের জন্য অনুমোদিত বিওডি সীমা প্রতি লিটারে ছয় মিলিগ্রাম বা তার কম হতে হবে। পরিশোধিত পয়োনিষ্কাশন ও শিল্পবর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য এই সীমা সর্বোচ্চ ৩০ মিলিগ্রাম।
ক্যাপসের গবেষণায় উঠে এসেছে, বুড়িগঙ্গার ছয় মৌসুমে আট স্থানের গড় বিওডি প্রতি লিটারে ১০৭.৯৪ মিলিগ্রাম, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ১৮ গুণ বেশি। বসন্তকালে বুড়িগঙ্গার গড় বিওডি গিয়ে ঠেকে ২১৭.৫০ মিলিগ্রামে, যা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ৩৬ গুণ বেশি। অন্যদিকে বিওডি সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে বর্ষায়। এ মৌসুমে বুড়িগঙ্গার প্রতি লিটার পানিতে ২৪.৩৮ মিলিগ্রাম বিওডি পাওয়া যায়। দূষণের পরিমাণ বেশি থাকায় বুড়িগঙ্গার আটটি স্থানের কোনোটিই মাছ চাষের উপযুক্ত ছিল না।
ক্রমেই ম্লান স্বচ্ছতা : পানির দৃশ্যমানতা বা ভিজিবিলিটি বলতে স্বচ্ছতাকে বোঝায়, যা দ্বারা বোঝা যায় পানির কত গভীর পর্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখা যায়। গবেষণায় হেমন্তে (মধ্য অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) বুড়িগঙ্গায় ধারাবাহিকভাবে সর্বোচ্চ দৃশ্যমানতা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বছিলা সেতু, হাজারীবাগ ও সদরঘাটে দৃশ্যমানতা ২৫ ইঞ্চিরও বেশি ছিল। বছরের এ সময় বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে ২২ ইঞ্চি দৃশ্যমানতা পাওয়া গেছে। বিপরীতে বসন্ত ও শীতকালে দৃশ্যমানতা সাধারণত কম ছিল। গড়ে সবচেয়ে কম দৃশ্যমানতা পাওয়া যায় বসন্তেই, মাত্র ৯ ইঞ্চি।
বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা ও তাপমাত্রা : বিশুদ্ধ পানিতে বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা কম থাকে। বুড়িগঙ্গার পানিতে সবচেয়ে বেশি তড়িৎ পরিবাহিতা পাওয়া গেছে যথারীতি বসন্তকালেই। বছরের এ সময়ে বুড়িগঙ্গার আট পয়েন্টে প্রতি সেন্টিমিটারে গড়ে ৯১৭ মাইক্রোসিমেন্স বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে কম, ১৮২ মাইক্রোসিমেন্স পাওয়া গেছে বর্ষাকালে। তবে বৈদ্যুতিক পরিবাহিতার সর্বোচ্চ সহনীয় মানদণ্ডের (প্রতি সেন্টিমিটারে এক হাজার ২০০ মাইক্রোসিমেন্স) নিচেই ছিল বুড়িগঙ্গার পানি।
পানিতে সহনশীল তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটলে তা জলজ প্রাণীর জন্যও হুমকিস্বরূপ। ছয় মৌসুমে বুড়িগঙ্গার আট স্থানের গড় তাপমাত্রা ২৭.৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ছিল শীতকালে, ২৩.১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সবচেয়ে বেশি গ্রীষ্মকালে, ২৯.৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী, পরিশোধিত পয়োনিষ্কাশনের জন্য অনুমোদিত সীমা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ ছাড়া বাকি মানদণ্ডগুলোর মধ্যে পানির ঘোলাটে ভাব (টার্বিডিটি) শীত ও বসন্তের মতো শুষ্ক ঋতুগুলোতে অনুমোদিত সীমা ছাড়িয়ে বেশি ছিল। বুড়িগঙ্গায় ছয় মৌসুমে আট স্থানের গড় অম্লত্ব বা পিএইচ (পটেনশিয়াল অব হাইড্রোজেন) পাওয়া গেছে ৭.৭৩। ঋতুভেদে পরিবর্তন হলেও বুড়িগঙ্গায় পিএইচের মাত্রা মাছ চাষ ও শিল্প উভয় উদ্দেশ্যের জন্য গ্রহণযোগ্য সীমার (৬ থেকে ৯) মধ্যেই রয়েছে।
ক্ষারত্বের (অ্যালকালিনিটি) মাত্রা বেশির ভাগ স্থান ও ঋতুতে সাধারণত প্রতি লিটারে ১৫০ মিলিগ্রাম থাকে, যা সাধারণভাবে উদ্বেগজনক নয়। পানিতে অদ্রবণীয় ক্ষুদ্র কঠিন পদার্থ বা টিএসএস সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ধোলাইখালে, যা অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেকটাই বেশি। মোট দ্রবীভূত কঠিন বা টিডিএসও ছিল নির্ধারিত সর্বোচ্চ মানদণ্ডের নিচে।
হারানো যৌবন ফিরে আসবে কি না : দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন ও নদী নিয়ে কাজ করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। ইংল্যান্ডের টেমস নদীও এককালে ভয়াবহ দূষিত ছিল এবং তা পরে দূষণমুক্ত করা গেছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা দূষণের প্রধান কারণ কলকারখানা থেকে আসা তরল ও কঠিন বর্জ্য। এগুলোকে প্রথম ধাক্কায় আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনায় পরিশোধন করতে হবে। এটা করলে পানির গুণগত মান অনেক উন্নত হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, বুড়িগঙ্গা একসময় ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি পেত। ৩০০ থেকে ৪০০ বছর আগে গঙ্গা থেকে পানি পেত, যে কারণে এটার নাম বুড়িগঙ্গা। ৫০ বা ১০০ বছর আগেও যমুনা নদী থেকে পানি আসত। সেই পানি পুনরুদ্ধার করলে এবং পানির প্রবাহ বাড়লে ধীরে ধীরে পানি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তৃতীয়ত, নদীর তলদেশ থেকে আবর্জনা তুলে প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়াতে হবে। এই তিনটি কাজ একসঙ্গে করলে বুড়িগঙ্গাকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। ‘
গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নদী নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদ ও নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি প্রকল্পের জন্য আলোচনা চলছে। এই প্রস্তাবের প্রধান উপাদানগুলোও প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলা হয়েছে।
তবে এই তালিকায় বুড়িগঙ্গা নেই জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘বুড়িগঙ্গার সমস্যা খুবই জটিল। শুধু ড্রেজিং (খনন) করলেই এর সমাধান হবে না। বুড়িগঙ্গার তলদেশে যে হাজার হাজার টন পলিথিন, সেগুলো অপসারণ করে আপনি কী করবেন? এর একটি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। দেড় বছরে আমাদের জন্য এর সমাধান খুঁজে বের করা অসম্ভব।’
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ