লুইস এনরিকের চোখের কোণে জল। সে জল গড়িয়ে পড়ল হাসিমাখা মুখে। এনরিকের অশ্রুসিক্ত অবয়ব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ফুটবপ্রেমীদের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। এ অশ্রু আনন্দের। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের। তবে এ অশ্রু বেদনারও। ১০ বছর আগে ২০১৫ সালে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করেন এনরিক। সে বছর বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বার্সা কোচের পাঁচ বছরের মেয়ে জানাকে উৎসব করতে দেখে আপ্লুত হয়েছিল দর্শক। সেই ছোট্ট মেয়ে জানা নয় বছর বয়সে ২০১৯ সালে ক্যানসারে বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে। এনরিকের মনের কোণে বারবারই উঁকি দিচ্ছিল ছোট্ট মেয়ে জানার মুখ। শুধুই কি এনরিকের মনে? জানা ছিল পিএসজি সমর্থকদের উৎসবেও। গ্যালারি সাইজের বিশাল পতাকায় আঁকা ছিল জানার ছবি। এনরিকের বেদনায় যোগ দিয়েছিলেন পিএসজির সমর্থকরাও।
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের রাত ঘুমহীন কেটেছে বিশ্বজুড়ে ফুটবলপ্রেমীদের। সে রাতে বিরল এক ম্যাচ দেখলেন তারা। ফরাসি ক্লাব পিএসজি দেড় দশক ধরে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে এলিটদের সারিতে নাম লেখানোর চেষ্টায় ছিল। কাতারি মালিক নাসের আল খেলাইফি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতেও কার্পণ্য করেননি সেরা হতে। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো গত শনিবার। মিউনিখের অ্যালাইঞ্জ অ্যারিনায় ইন্টার মিলানকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ইউরোপসেরা হলো পিএসজি। দ্বিতীয় ফরাসি ক্লাব হিসেবে এ গৌরব অর্জন করল দলটি। এর আগে ১৯৯৩ সালে এসি মিলানকে হারিয়ে প্রথম ফরাসি ক্লাব হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করে মার্সেই।
ফাইনালে ইন্টার মিলানকে নিয়ে ছেলেখেলাই খেলল পিএসজি। ম্যাচের ১২ মিনিটে আশরাফ হাকিমি গোলের খাতা খোলেন। এরপর ডেজিরে ডুয়ে ২টি (২০ ও ৬৩ মিনিটে) এবং খিচা কাভারেস্কাইয়া (৭৩ মিনিটে) ও মাইয়ুলু (৮৬ মিনিটে) ১টি করে গোল করেন। প্রতিটি গোলের সময়ই আলোকিত হয় প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। ৫ গোলের জয়ে দারুণ এক রেকর্ড গড়েছে পিএসজি। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের (আগের নাম ইউরোপিয়ান কাপ) ইতিহাসে এত বড় ব্যবধানে কেউ কখনো ফাইনাল জয় করেনি। তা ছাড়া আরও একটি রেকর্ড অক্ষুণœ রেখেছে পিএসজি। মিউনিখের মাটিতে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে নতুন দলগুলোই কেবল চ্যাম্পিয়ন হয়। এর আগে এ শহরে নতুন দল হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নটিংহ্যাম ফরেস্ট (১৯৭৯), মার্সেই (১৯৯৩), বুরুসিয়া ডর্টমুন্ড (১৯৯৭) ও চেলসি (২০১২)।
উৎসব করার সব প্রস্তুতিই নিয়ে রেখেছিলেন পিএসজি সমর্থকরা। অ্যালাইঞ্জ অ্যারিনায় ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গ্যালারিতে উল্লাসে ফেটে পড়েন তারা। ফরাসি ফুটবলপাগলদের সামলাতে স্টেডিয়ামে কড়া নিরাপত্তাই ছিল। কিন্তু পিএসজি ফুটবলারদের হাতে ট্রফি দেখার পর এ পাগলদের আর সামলায় কে! জার্মান পুলিশদের দর্শক বানিয়ে গ্যালারির বাধা টপকে মাঠের দখলে নেন তারা। অবশ্য পাগল-সমর্থকদের পিএসজি ফুটবলারদের কাছাকাছি যেতে দেয়নি পুলিশ। নিরাপদে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। মিউনিখের চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ছিল প্যারিসে। উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে তারা এতটাই বুনো হয়ে পড়ে যে দুজন ফুটবল সমর্থক পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আহত হয়েছে পুলিশ।
ফুটবল এমনই। এখানে জয়-পরাজয়ে জীবনের গান আর মৃত্যুর বিষাদ পাশাপাশি চলে। তার পরও ফুটবল নিয়েই বেঁচে থাকে কোটি কোটি মানুষ। এ খেলার প্রতিটি সেকেন্ড তাদের নতুন জীবনের সন্ধান দেয়। যেমন করে পিএসজিকে দিল! যেমন করে লুইস এনরিক এ স্বাদ পেলেন! স্প্যানিশ এ কোচ ফুটবলের ইতিহাসে অনন্য নজির স্থাপনকারী পেপ গার্ডিওলার পাশে নাম লেখালেন। গার্ডিওলা ২০০৮-০৯ মৌসুমে বার্সেলোনার এবং ২০২২-২৩ মৌসুমে ম্যানসিটির কোচ হিসেবে ট্রেবল জয় করেছেন। এনরিক ২০১৪-১৫ মৌসুমে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে ট্রেবল জয় করেন। এবার পিএসজির কোচ হিসেবেও ট্রেবল জয়ের গৌরব অর্জন করলেন। ইতিহাসে দুবার ট্রেবল জয় কেবল এ দুজনেরই আছে।