ডেঙ্গুজ্বরের থাবায় চলতি বছরে প্রাণ হারিয়েছে ১০৫ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার মানুষ। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ব্যথায় জর্জরিত শরীর। এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীও। এডিস মশার কামড়ে প্রাণঘাতী এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সচেতনতা ও সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে মশাবাহিত রোগে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২৫ বছরে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রায় ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৃদ্ধি কোনো একক কারণের ফল নয়। বিশ্বায়ন, নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব এ বিস্তারে প্রভাব ফেলেছে। দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার এখন শুধু প্রাকৃতিক ঋতু পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে না। মশার জীবনচক্র তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওপর যেমন নির্ভরশীল, তেমন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ ভেক্টরগুলোর প্রজনন মৌসুমও প্রসারিত হয়েছে। হালকা বৃষ্টিপাত মশার প্রজননস্থলগুলো পুনরায় সক্রিয় করে এবং প্রাপ্তবয়স্ক মশার আয়ু ও বিস্তার বাড়িয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর উপস্থিতি ও মশার ঘনত্বের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যদি কোনো এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব বেশি থাকে এবং সেখানে ডেঙ্গু রোগীও থাকে, তাহলে রোগটি জ্যামিতিক হারে ছড়াতে থাকে। কিন্তু যদি রোগী থাকে অথচ মশা না থাকে বা মশা থাকে অথচ রোগী না থাকে তাহলে রোগটি ছড়ায় না। এ রোগী-মশার সংযোগটি ভেঙে দিতে পারলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘মশার ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের আরেকটি প্রধান উপায় ব্রিডিং সোর্স ম্যানেজমেন্ট। যেসব পাত্রে পানি জমে থাকে যেমন ফুলের টব, প্লাস্টিকের কনটেইনার, পরিত্যক্ত টায়ার, নির্মাণাধীন ভবনের পানির ট্যাংক, বহুতল ভবনের বেসমেন্ট, ঘরের ভিতরে ড্রাম বা বালতিতে জমিয়ে রাখা পানি ইত্যাদি সেগুলো সরিয়ে ফেলতে বা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। যেসব স্থানে পানি জমা থাকা অনিবার্য কিন্তু ফেলে দেওয়া বা পরিষ্কার করা যাচ্ছে না, সেগুলোতে কীটনাশক প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ কাজে শুধু সিটি করপোরেশন নয়, সাধারণ নাগরিককেও সম্পৃক্ত করতে হবে। ছোট্ট শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ কেউ রেহাই পায়নি ডেঙ্গুর কবল থেকে। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় বসেছিলেন মানিকগঞ্জের সাদিয়া খাতুন (১৯)। ছয়টি পরীক্ষা দেওয়ার পরে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। সাদিয়া বলেন, ‘মানিকগঞ্জের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে অবস্থার অবনতি হলে মহাখালী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডেঙ্গুর কারণে আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আমার জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে গেল, পরিশ্রম বৃথা গেল।’ রাজধানীর মহাখালী ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে তিন বছরের মেয়ে সামাইরাকে ভর্তি করেছেন কেরানীগঞ্জের ফাহমিদা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রথমে বড় মেয়ের জ্বর আসে। এরপর ছোট মেয়ের। বড় মেয়ে সুরাইয়ার জ্বর সেরে গেলেও সামাইরার জ্বর সারছিল না। টেস্ট করে দেখা যায় সে ডেঙ্গু আক্রান্ত। জ্বরের সঙ্গে বমি, পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা শুরু হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন চিকিৎসক। এখন সে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে।’
জ্বর এলে করণীয় সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তুষার মাহমুদ বলেন, ‘এখন ঘরে ঘরে জ্বর হচ্ছে। হাসপাতালেও রোগীর ভীষণ চাপ। জ্বরের সঙ্গে শরীরে ব্যথা, পাতলা পায়খানা, গায়ে র্যাশ ওঠা বিভিন্ন রকমের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। তাই জ্বর এলে প্রথমে ডেঙ্গু কি না তা শনাক্তে টেস্ট করতে হবে। জ্বর কমাতে নিজে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছতে হবে এবং বেশি তরল পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।’ তাজা ফলের রস, স্যুপ, পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ডেঙ্গুর পাশাপাশি এ বছর চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এ বছর ডেঙ্গুর পাশাপাশি জেঁকে বসেছে চিকুনগুনিয়া। ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ৩৩৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৫৩ জনের দেহে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্ত সবাই ঢাকার বাসিন্দা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আহমেদ নওশের আলম এ তথ্য জানিয়েছেন। আইইডিসিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়। ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে কিছু রোগী পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে আবার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ওই বছর প্রায় ১৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৬ ডিসেম্বর আইইডিসিআর জানায়, জিকায় ১১ ও চিকুনগুনিয়ায় ৬৭ জন আক্রান্ত। চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশা। আইইডিসিআর জানিয়েছে, এবার চিকুনগুনিয়া নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত হচ্ছে ৪৫ শতাংশ রোগী।
দেশে প্রথমবারের মতো জিকা ভাইরাসের ক্লাস্টার শনাক্ত করা হয়েছে। জিকা ভাইরাসের জীবাণু বহন করে এডিস মশা। আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীদের গবেষণায় পাঁচজন জিকা-পজিটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষার জন্য ২০২৩ সালে ১৫২ রোগীর নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। জ্বরের পাশাপাশি তাদের ভাইরাসের অন্যান্য লক্ষণ ছিল। যাদের জিকা শনাক্ত হয়েছে তারা সবাই ঢাকার একই এলাকার বাসিন্দা বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি।