উর্দু সাহিত্যের সেরা লেখকের একজন সাদত হাসান মান্টো। তিনি ছিলেন কাশ্মীরি। জন্ম পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় ১৯১২ সালের ১১ মে। মান্টোর বাবা গুলাম হাসান পাঞ্জাব সরকারের একজন মুনসেফ ছিলেন, পরবর্তীতে জজ হন। গুলাম হাসানের দ্বিতীয় স্ত্রী সরদার হাসানের ঘরে জন্ম নেন মান্টো। দেশত্যাগের বিরূপ ভাগ্যবরণকারী লেখক সাদত হাসান মান্টো। ভারত-পাকিস্তান মিলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার তিনি। তাঁকে গণ্য করা হয় আধুনিক উর্দু সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা হিসেবে। ‘দেশভাগের কথাকার’ নামেও পরিচিত সাদত হাসান মান্টো। দাঙ্গা, হাঙ্গামা, রাজনৈতিক পালাবদল, দেশান্তর, জীবন সংকট মিলিয়ে ভয়ংকর সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তিনি বেঁচেছেন মাত্র ৪৩ বছর। গালিবের মতোই ছিল তাঁর পীড়িত জীবন আর দুর্ভাগ্যের নিয়তি। গালিব ও মান্টো উভয়েই দেখেছেন রাজনৈতিক হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাসকবলিত, রক্তপ্লাবিত ভারত। আর মান্টোর চোখের সামনে দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে সাম্প্রদায়িক রক্তাক্ত হানাহানির পথে বিভক্ত উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র। নিজের মৃত্যুর এক বছর আগে যিনি লিখতে পারেন, ‘এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মান্টো। আর তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প লেখার সমস্ত কৌশল।’ এ যেন আঁধারের বুকে এক আলোর জীবনশিল্পী সাদত হাসান মান্টো।
সাদত হাসান মান্টোর বিখ্যাত গল্প ‘ঠান্ডা গোশত’। দেশভাগের পর একরকম মানসিক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাকিস্তানে এসে লেখা ঠান্ডা গোশত মান্টোর সাড়া জাগানো গল্প। গল্পটা প্রকাশ পেতেই পুরো পাকিস্তানে হইচই পড়ে যায়। আদালতের কাঠগড়ায় পর্যন্ত যেতে হয় মান্টোকে। চরম বাস্তববাদী সাহিত্যিক মান্টো তাঁর লেখায় মনস্তত্ত্বের যে গভীর বিশ্লেষণ রেখে গেছেন, তা পাঠককে ভাবিয়ে তোলে। সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসনের খামখেয়ালি তাঁকে তাড়িত করেছে সব সময়। নিছক গল্প বলতে নয়, কালের মহা সত্য ফুটিয়ে তুলতেই গল্পের নামে জীবনবোধকে লিখে গেছেন মান্টো। ঠান্ডা গোশত গল্পের পটভূমি ১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ইশের সিং তাঁর প্রণয়িনী কালবন্ত কাউরকে বিছানায় সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হলে কালবন্ত কাউর তাঁকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত করে এবং মনে করে সে অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। এরপর কালবন্ত কাউর মাটিতে পড়ে থাকা কৃপাণ দিয়ে ইশের সিংকে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে। মরার সময় ইশের সিং জানায়, সে দাঙ্গার সময় একটি মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে রায়টে যুক্ত ছিল। একটি মুসলিম পরিবারের ছয়জন সদস্যকে সে ওই কৃপাণ দিয়ে খুন করে। এরপর সে বাড়ির ভিতরে ঢোকে এবং একটি মেয়েকে দেখতে পায়। মেয়েটিকে ঘাড়ে করে তুলে বেরিয়ে আসে সে এবং ঝোপের আড়ালে নিয়ে এসে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু মেয়েটি ছিল মৃত, একদম ঠান্ডা গোশতের মতো। ঠান্ডা গোশত উর্দু ভাষায় রচিত। পাকিস্তানের একটি সাহিত্য সাময়িকীতে ১৯৫০ সালের মার্চে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল। পরবর্তীতে সাঙ-এ-মিল পাবলিকেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। বাংলায় বইটি অনুবাদ করেন কাউসার মাহমুদ যেটি পেন্ডুলাম পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
অমৃতসরের মুসলিম হাইস্কুলে লেখাপড়া শুরু হয় মান্টোর। কিন্তু পড়ালেখায় অমনোযোগী মান্টোর স্কুলে দমবন্ধ হয়ে আসত। কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না, উর্দু সাহিত্যের সেরা এই লেখক তিনবার উর্দুতে ফেল। চতুর্থবারের চেষ্টায় ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। লেখালেখির কারণে কখনো এসেছে ফতোয়া, কখনো আবার অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। দেশভাগের আগে তিনবার তাঁকে গল্পে অশ্লীলতা ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। একই অভিযোগ দেশভাগের পর পাকিস্তান গিয়েও পেতে হয়েছে তাঁকে। বারবার অভিযুক্ত হওয়ার পর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মান্টো বলেছিলেন, ‘একজন লেখক তখনই কলম ধরেন, যখন তাঁর সংবেদনশীলতা বা অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়!’ বেঁচে থাকতে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেই অপমান করা হয়েছে মান্টোকে। দেশভাগের সময় নিজের জন্ম শহর বোম্বে ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয়েছিল পাকিস্তানের লাহোরে। তবে সেখানে তিনি আজীবন ছটফট করেছেন নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য। মান্টোর কলমে উঠে এসেছে ৪৭-এর দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশভাগের সময় মানুষের মনের কদর্যতা। মান্টো একদম চোখের সামনে যেমন ঘটেছে তেমনটাই লিখেছেন অকপটে কোনো পক্ষ অবলম্বন না করে, নির্দ্বিধায়। মান্টোর লেখা পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে চোখের সামনে কোনো সিনেমা দেখছেন। মাত্র ৪৩ বছরের সময়ে নিজেকে ছোটগল্পের একজন ঈশ্বরে পরিণত করেছিলেন মান্টো। ২২টি ছোটগল্পের সংকলন, একটি উপন্যাস, সাতটি রেডিও নাটক, তিনটি প্রবন্ধ সংকলন আর দুটি স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ লিখেছিলেন মান্টো। তার্কিক আবদুল বারি আলিগের সঙ্গে ১৯৩৩ সালে তাঁর পরিচয়। এ পরিচয় মান্টোর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি মান্টোকে ফরাসি এবং রাশিয়ান ভাষা শিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলশ্রুতিতে এ দুটি ভাষা শিখে মান্টো সে ভাষার বিখ্যাত বিভিন্ন গল্প অনুবাদ করতে শুরু করেন। ১৯৩৪ সালে মান্টো ভর্তি হন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সময় থেকেই পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন মান্টো এবং ধীরে ধীরে ভারতের প্রভাবশালী সাহিত্যিকে পরিণত হন। কাশ্মীরের মেয়ে সুফিয়াকে বিয়ে করেছিলেন মান্টো। তাদের ঘরে তিনটি মেয়ে এবং একটি ছেলে ছিল। ১৯৪৩ সালের মধ্যে বেশ কিছু রেডিও নাটকও লিখে ফেলেন। মান্টোর জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরুও তখন থেকেই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ছোঁয়া লাগে তাঁর জীবনেও। মুসলমান হওয়ায় বোম্বে টকিজ ফিল্ম থেকে চাকরি হারান, সেই সঙ্গে পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে পালিয়ে যান পাকিস্তানের লাহোরে। শরণার্থী হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার পর নিজেকে একপ্রকার হারিয়েই ফেলেন মান্টো। কারণ বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আর পাকিস্তানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে ছিল আকাশপাতাল ফারাক। এ ছাড়া সেখানে তাঁর কোনো বন্ধু ছিল না। সেখানেও লেখালেখির জন্য অপমানিত হওয়া ছিল তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় ছিল। তখন বাধ্য হয়ে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে রম্যরচনা আর ছোটগল্প লিখে পাঠাতে শুরু করেন। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে মদে বুঁদ হয়ে থাকতেন। সে সময় মদের টাকা জোগাতেই নাকি লিখতেন বলে জানা যায়।
ভালোবাসার শহর বোম্বে থেকে পালিয়ে আসা এবং দেশভাগের যন্ত্রণায় পুরোপুরি অস্থির হয়ে পড়েছিলেন মান্টো। বন্ধু ইসমত চুগতাইয়ের কাছে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘কোনোভাবে আমাকে ফেরত নিয়ে যাও, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।’ সাদত হাসান মান্টো লেখক হিসেবে পাকিস্তানে খুব একটা সম্মান পাননি। কিন্তু অনেকের মতে, জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো পাকিস্তানেই লিখেছেন। কারণ, সে সময়টায় তিনি নিজের দেশ হারানো, দেশভাগ, মানুষের বিভেদ আর নতুন পরিবেশের যন্ত্রণায় থেকে একদম নির্মম সত্যগুলো তুলে এনেছিলেন কলমের ডগায় নিখুঁতভাবে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ‘বু’, ‘টোবা টেক সিং’, ‘ঠান্ডা গোশত’, ‘তামাশা’ এগুলো মান্টোর উল্লেখযোগ্য রচনা। রুশ ও ফরাসি ভাষা আয়ত্তে আসার পর মান্টো ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত ‘The last Day of a Condemned Man’ এর উর্দু অনুবাদ করেছিলেন। যা পরবর্তীতে ‘সারগুজাস্ত-ই-আসির’ (বাংলায় এক বন্দির গল্প) নামে উর্দুতে প্রকাশিত হয়েছিল। মান্টোর হাতে রাশিয়ান গল্পের উর্দু অনুবাদ ‘রাশি আফ্সানে’ প্রকাশিত হয়। বিদেশি সাহিত্য উর্দু ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে মান্টো যেন এক অন্য জগতের সন্ধান পেলেন। কিংবদন্তি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো, অস্কার ওয়াইল্ড, আন্তন চেখভ, ম্যাক্সিম গোর্কির লেখার সঙ্গে আগে খানিক পরিচয় থাকলেও এ সময় তাঁর বিস্তৃতি ঘটেছিল বৃহৎ পরিসরে।
অনিয়মতান্ত্রিক স্বভাব আর যাযাবর জীবন তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে দেয়। যক্ষ্মা ধরা পড়ে। যক্ষ্মা ধরা পড়ার পর চিকিৎসক তাঁর পূর্ণ সুস্থতার জন্য হাওয়া বদল করতে বললেন। মান্টো চলে গেলেন কাশ্মীরের বতুতে। কাশ্মীরে থাকা অবস্থাতেই ১৯৩৪ সালে মান্টোর জীবনে প্রথম প্রেম এলো। সেই প্রেমটাও ছিল অসম্ভব স্নিগ্ধ। মান্টো কাশ্মীরের বতুতে থাকা অবস্থায় প্রায়ই পাহাড়ি উপত্যকায় ঘুরতে যেতেন। এভাবে ঘুরতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো এক কাশ্মীরি মেষবালিকার। যে মেষের পাল চরাত। এ প্রেমটিকে মান্টো বলেছিলেন অপরিপক্ব প্রেম। তবে এ প্রেমের কথা জীবনেও কখনো মান্টো ভুলতে পারেননি। এই মেয়ের পরিচয় ও গল্প মান্টো তুলে এনেছিলেন তাঁর এক টুকরো মিছরি গল্পে। যেখানে মান্টো মেয়েটির নাম দিয়েছিলেন ‘বিত্ত’। মান্টোর প্রথম গ্রন্থ ছিল গল্পগ্রন্থ ‘আতিশ পারে’। ‘আতিশ পারে’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। মুসাব্বির পত্রিকায় থাকাকালীন চার বছর অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন মান্টো। মূলত এ পত্রিকায় থাকাকালীন চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখতেন মান্টো। এ পত্রিকায় থাকা অবস্থায়ই ফের সাহিত্যের প্রতি অসম্ভব এক টান অনুভব করলেন মান্টো। ১৯৪০ সালে মান্টো যোগ দিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। ১৫০ টাকা বেতনে দিল্লিতে চাকরি। এটি ছিল মান্টোর জন্য দারুণ এক সুযোগ। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে থাকা অবস্থাতেই ১৯৪১ সালে প্রকাশিত মান্টোর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘মান্টো কে আফসানে’।
ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে ৩০০ টাকা বেতনে সংলাপ রচয়িতা ও চলচ্চিত্রের কাহিনিকার হিসেবে কাজ করছিলেন মান্টো। এখানে থাকাকালীন তাঁর কাহিনিতে গড়ে উঠেছিল দারুণ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ‘গালিব’ চলচ্চিত্রের কথা বলতেই হয়। যদিও এ চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল অনেক পরে। সুপারহিট হয়েছিল চলচ্চিত্রটি। পেয়েছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ কেবল উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব অংশকে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত করেনি, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক দিক থেকেও চরমভাবে বিপর্যস্ত ও রক্তাক্ত করেছিল। বিশেষত, পশ্চিম প্রান্তে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ সম্প্রদায় রাজনৈতিক উন্মাদনায় পরস্পরের রক্তে হোলিখেলায় মেতেছিল। উর্দু সাহিত্যে মান্টো এবং আরও অনেকেই, যেমন খুশবন্ত সিং, অমৃতা প্রীতম, কৃষণ চন্দর, খাজা আহমদ আব্বাস, ইসমৎ চুগতাই, কুদরৎ উল্লাহ সাহাব, রাজিন্দর সিং বেদি প্রমুখ দেশভাগের পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক নখরে ক্ষতবিক্ষত মানুষ ও মানবতার কথাকার হয়ে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। আর মান্টো এ তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছেন নিজের সম্পৃক্ততা, সাবলীলতা ও সাহসিকতার জন্য। জীবদ্দশায় নিজের কাজের তেমন স্বীকৃতি পাননি মান্টো। একপ্রকার অবহেলা আর অভাবকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি এক শীতের ভোরে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ছোটগল্পের ঈশ্বরখ্যাত লেখক সাদত হাসান মান্টো।