গল্প
মার্চ, ১৯৯০
সুখেনদার চায়ের দোকানের নিয়মিত আড্ডাটা বসে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু যার উপস্থিতি এ আড্ডার প্রাণ, স্বাধীন নামের টগবগে সেই তরুণটি এখনো আসেনি।
তর্ক, টেবিল চাপড়ানো সবই চলছে কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল ওতে কারও মন নেই। সবারই চোখ কিছুক্ষণ পর পর রাস্তার দিকে খোলা চত্বরে। এই বুঝি এলো সে।
ভিক্টোরিয়া কলেজ রোডের বুকের ওপর সুখেনের চায়ের দোকানটা ঝাঁপ খোলে সাতসকালেই। ওদের আড্ডাটা কলেজের সময় ধরে শুরু হলেও শেষ হওয়ার কোনো ধরাবাঁধা সময় নেই। কোনো কোনো সময় রাত ১১টা পেরিয়ে গেলে সুখেন বাধ্য হয়ে লাকড়ির চুলায় পানি ঢেলে ভেজা কাঠ দিয়ে ধোঁয়ায় ঘর ভরিয়ে দিয়ে মশা তাড়ানোর মতো ওদের তাড়ায়।
মুখে কিছু বলে না। বলবে কী, দোকানের কর্তা সুখেন নিজেও ওদের মতোই তরুণ।
কথার পিঠে কথার জোগান দেওয়ার দক্ষতাই এ আড্ডার যোগ্যতা। ভিক্টোরিয়া কলেজের ভিন্ন বিষয়ের কিন্তু একই বর্ষের একঝাঁক তরুণ। রাগ-বিরাগ, মান অভিমান করে চায়ের কাপ ভেঙে রাগের মাত্রা প্রকাশ করা সবই এখানে হয়। কিছুক্ষণ বাদে আবার হা-হা, হি-হি। তবে আজ আড্ডাটা তেমন জমছিল না। কারণটা যেন সবারই মনে মনে জানা।
বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়ার সহজ দক্ষতার গুণে স্বাধীনই বলতে গেলে আড্ডার প্রাণ।
কথা বলতে জানে, হাসতে জানে, হাসাতে জানে, আবার কখনো কখনো ঝিম মেরে সারা দিন একটি কথাও না বলে বসে থাকতেও জানে। মনে মনে সবারই প্রশ্ন,
-আসছে না কেন আজ? আবার সেই পুরোনো অসুখ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল না তো!
-সুখেনদা চা দাও। তৃতীয় দফা চায়ের অর্ডার দিল তিনু।
-কারণটা কী? আজকাল সে প্রায়ই গরহাজির থাকছে।
-বিরক্তি হারুনের কণ্ঠে।
-মনে হচ্ছে সেই পুরোনো বিষয়টি আবার, -অসমাপ্ত ইঙ্গিত বিকাশের।
-কিন্তু তা কি সম্ভব? এই এতগুলো বছর বাদে?
আশঙ্কা প্রকাশ করে মিন্টু।
-ফিফটি ফিফটি। শহরের মূল হলো এই কান্দিরপাড় এলাকা।
বিকাশ তার যুক্তির পক্ষে ব্যাখ্যা দিতে গেল।
-যদি সেই লোকটি, স্বাধীনের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এ শহরে থেকে থাকে এবং সে যদি চলাফেরা করতে সক্ষম হয় তাহলে আজ হোক, কাল হোক কোনো না কোনো দিন কি এই এলাকা দিয়ে যেতে পারে না? সেই লোকটা, যাকে স্বাধীন খুঁজছে, কখনো যদি ইচ্ছা হয়, যাই একটু ঘুরে আসি প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে। কিংবা নাতির হাত ধরে একটু বাজারে যাই, তাহলে? বলা তো যায় না দেখা পেয়েও যেতে পারে।
সবাই চুপ। বিকাশের কথার কোনো জবাব কেউ খুঁজে পায় না। শুনে গেল।
ও আবার যোগ করল,
-বিষয়টা স্বাধীনের বিশ্বাসের গভীরে গেঁথে আছে। আমারও ধারণা ও ব্যর্থ হবে না।
-এতগুলো বছর বাদে-লোকটা কি বেঁচে আছে?- প্রশ্নটা তিনুর।
-স্বাধীন তো বলে যে সে নিশ্চিত, লোকটা বেঁচে আছে।
উত্তর দিল বিকাশ।
-চেহারা বদলে যেতে পারে না?
-পারে। মুখভর্তি দাড়ি গজাতে পারে। কিন্তু চোখ! চোখের দৃষ্টি বদলে যায় না মানুষের।
হারুনের দার্শনিক সমাধান। হতাশ মিন্টু মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল। বলল, -যত্তসব অবাস্তব জেদ। দিনের পর দিন এসব। -বিরক্ত সে।
-তুই কী বুঝবি, সম্ভব কি অসম্ভব? ইচ্ছের জোর থাকলে সবই সম্ভব। স্বাধীনের জীবনে যা ঘটে গেছে, তা যদি তোর-আমার জীবনে ঘটত তাহলেই ওর দুঃখ আঁচ করা যেত। তখন আর ওর ইচ্ছেটাকে পাগলামো বলে মনে হতো না।
গুরুগম্ভীর স্বরে আলাপের ইতি টানল হারুন। এ কথার পর পুরো আড্ডার আমেজ স্বাধীনের গভীর দুঃখে একাত্ম মৌনতায় বরফ হয়ে যায়।
চা খাওয়ার পর আড্ডার ইতি হয় সেদিনের মতো।
দুই
স্বাধীন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পূবালী ব্যাংকের সামনে কান্দিরপাড় আইল্যান্ডের গোল চত্বরের ওপর। ব্যাপারটা সবার চোখে লাগার মতো। কিন্তু স্বাধীনের আর কোনো আরাধনা নেই।
তার ইচ্ছেটা এ রকমই। চারদিক থেকে আসা রিকশারোহী, হেঁটে চলা মানুষ, গাড়ি সবই তার নজরে আসে এখান থেকে। ওর পরনে খদ্দরের সাদা ঝুল পাঞ্জাবি। লম্বাটে গড়ন, শেভ না করা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মুখ। ঝকঝকে চোখের দৃষ্টি জনারণ্যে প্রতিটি মানুষের মুখের ওপর।
যে কেউ ওকে পাগল মনে করবে। করুক। স্বাধীন তাতে ভ্রুক্ষেপ করে না।
ওর নিজের ধারণা, যার জন্য সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, খুঁজে ফেরে তার দেখা সে পাবেই। প্রতিদিন বেলা শেষে হতাশ হওয়ার বদলে ওর জেদ বাড়ে। বিশ্বাস দৃঢ় হয়। পেতেই হবে তাকে।
সেই দুঃসহ স্মৃতি তো ভোলা যায় না। তার বাবা-মায়ের হত্যাকারীর চেহারা, চোখের দৃষ্টি কী করে ভুলবে সে? গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, নাম পাল্টিয়ে সে এ শহরে অথবা শহরতলিতে কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে। চেহারা বদলে যেতে পারে ঠিকই, কিন্তু চোখ!
খুনির চোখই বলে দেবে, এই সেই লোক!
তরুণের পলকহীন দৃষ্টি প্রায় প্রতিটি চলমান মানুষের মুখের ওপর। আইল্যান্ড থেকে একটু দূরে হুডতোলা রিকশার বাইরে গলা বাড়িয়ে স্বাধীনকে ডাকল প্রতিমা। শুনতে পাওয়ার কথা নয়। চারদিকে প্রচণ্ড কোলাহল। আর তা ছাড়া যুবকের খেয়ালও নেই অন্য কোনো দিকে।
আরও কাছে রিকশাটা ঘুরিয়ে এনে ধমকে উঠল প্রতিমা, -শুনতে পাচ্ছিস না তোকে ডাকছি?
প্রতিমার মুখের ওপর চকিতে থমকাল স্বাধীনের দৃষ্টি। ওকে এ সময় আশা করেনি সে। কারও অনুরাগ অথবা বিরাগ এ মুহূর্তে তাকে স্পর্শ করুক, তা তার কাম্য নয়। রাগটা চেপে ঠান্ডা মাথায় চোখ চলমান জীবনে রেখে জবাব দিল, -এখন না, পরে।
-চলে আয়, কথা আছে।
হাত তুলে ডাকে অষ্টাদশী। তাতে অবাক হলো জেদি যুবক প্রতিমার কাণ্ডজ্ঞান দেখে।
ওর বন্ধুরা, সামনে অনুরাগী প্রিয়তমা মেয়েটি, সবাই জানে, কেন ওর অদ্ভুত এ অনুসন্ধান। তারপরও তাকে ডেকে সরিয়ে নিতে চাইল বলে স্বাধীনের রাগটা আরও ঘন হলো।
-কথা থাকলেই তোর সঙ্গে যেতে হবে নাকি? তীক্ষè তীরের খোঁচায় থমকাল প্রতিমা। নরম সুরে বলল, -এই রোদের মধ্যে কত আর দাঁড়িয়ে থাকবি।
ধমকে উঠল স্বাধীন, -ন্যাকামো করিস না, চলে যা। কেন মিছিমিছি বিরক্ত করিস!
কোনো জবাব না দিয়ে অভিমানাহত প্রতিমা চলে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকেই শাপ-শাপান্ত করে স্বাধীনকে বিরক্ত করার জন্য। মনে মনে প্রার্থনা করে, -হে আল্লাহ! তুমি ওর মনের বাসনা কবুল কর।
জনারণ্যে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাবা-মায়ের মুখটা মনে পড়ে স্বাধীনের।
আরেকটা দিনের অবসান হচ্ছে। আজকাল ক্ষুধা, তৃষ্ণার কথা মনেও থাকে না। অবসন্ন লাগছে এখন। তবুও আরও ঘণ্টা তিনেক এখানে থাকবে সে। একেকটি মুখ, একেকটি জীবন। একেকটি সংসার। হাসি, আনন্দ, সুখ। সন্তানের আনন্দে বাবা-মায়ের তৃপ্ত মুখ।
এক সময় মনে হয় সবারই সব আছে। ওরই কেবল নেই। নেই কেন?
’৭১-এর সাত বছরের বালক আজ পরিণত যুবক। স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক কিছুই বদলেছে দিনে দিনে। বদলে গেছে নব্বই ভাগ মানুষের চরিত্র, মন-মানসিকতা। কিন্তু কোনো কোনো মানুষের স্মৃতি?
যার চোখের সামনে খুন হলো প্রিয়তম বাবা-মা, সে কী করে ভুলে যাবে সেই সময়?
যে মানুষটি রাস্তা দেখিয়ে আদর করে পাকিস্তানি হায়েনাদের ডেকে এনে গুলি করে খুন করাল হাসান মাহমুদ মাস্টার আর তার বউকে, তাকে কি বিস্মৃত হওয়া সম্ভব?
স্মৃতির আয়নায় স্পষ্ট, আজও উজ্জ্বল খুনির দোসর শান্তি কমিটির প্রধান মফিজউদ্দীন মোড়লের লোভাতুর চোখ। ধানের গোলার আড়ালে খড়ের গাদায় লুকিয়ে থেকে স্বাধীন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল মোড়লের গলার আওয়াজ, -আইয়ে, আইয়ে মেজর সাহাব। আইয়ে।
সাতজনের একটি হায়েনার দলকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসতে আসতে তার বাবার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলতে লাগল, -দেখিয়ে, ও লোগ, ইয়ে পাকিস্তানকা দুশমন হ্যায়। হররোজ মুক্তিকো মদত দেতা হ্যায়।
মেজর গর্জে উঠল, -পাকড়ো দোনোকো।
সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীরা দাওয়ায় হতবাক বসে থাকা বাবাকে এবং ঘরের ভেতরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে ধরে এনে উঠোনের পেয়ারা গাছটার সঙ্গে বেঁধে ফেলে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাধীন শুনল বন্দুকের গুলির শব্দ এবং তার জনক-জননীর আর্তচিৎকার।
বিপদ জেনেও খড়ের গাদার ভেতর থেকে সে দেখল, মফিজ মোড়লের চকচকে তৃপ্ত মুখ। মেজর এবং রাজাকারদের মিলিত উচ্চহাসি। পাক সেনারা চলে যেতেই খড়ের গাদার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে বালক।
মোড়ল তখনো তার মৃত রক্তাক্ত বাবা-মায়ের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের লোকজনের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওকে দেখেই মোড়ল, ধর ধর, ওরে ধর, চিৎকার করে উঠতেই ছুটে পালায় সে। আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে সেই রাতেই চানপুরে নানাবাড়িতে এসে ওঠে স্বাধীন।
তার পরদিন বড় মামার সঙ্গী হয়ে আগরতলা সোনামুড়ার লুদিজোলা ক্যাম্পে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে এসে নানা বাড়িতেই মানুষ।
লেখাপড়া, বড় হওয়া আজকের যুবক। কিন্তু মনের ভেতরে সব সময়ই জেগে আছে, জেগে ছিল, একদিন না একদিন সে মোড়লকে খুঁজে বের করবেই।
স্কুল পাস করে শহরে এসে ভিক্টোরিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তার খোঁজাখুঁজি শুরু। এখন সে শিক্ষা জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে।
ধৈর্যহারা হয়নি সে এতটুকু। আজও। দিনের পর দিন। তার বিশ্বাস প্রতিদিনই যেন দৃঢ় হয়। আছে সে, এই শহরেই। পেতেই হবে তাকে।
খোঁজ নিয়ে জেনেছে সে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ওদের জায়গা-জমি দখলে নিয়ে বিক্রি করে গাঁয়ের পাট চুকিয়ে শহরে চলে যায় মফিজ মোড়ল। কোথায়? কেউ জানে না।
কিন্তু এই যুবক, রোদে পোড়া, শ্রমক্লান্ত, ক্ষুধিত বাঘের মন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, মফিজ মোড়ল একদিন, এই পথে চিহ্ন রেখে যাবেই। ওর মরণ তার হাতে।
আজ আর আড্ডায় যাওয়া হলো না ওর। প্রতিমার জন্য মনটা খারাপ হলো আরও।
কেন যে মেয়েটি বোঝে না! মাঝে মাঝেই এর জন্য খুব রূঢ় আচরণ করে ফেলে সে। কিন্তু কিছু করার নেই। আজ নানা বেঁচে নেই। নানিও চলৎশক্তিরহিত। মামারা খুবই ভালোবাসে তাকে। ওরা সবাই জানে, স্বাধীনের এই নিরন্তর খোঁজার কাহিনি।
একমাত্র মামারা ছাড়া আর সবাই একে পাগলামি বলে ধরে নিয়েছে। কিন্তু স্বাধীন জানে, মোড়লের মুখোমুখি হতে না পারলে মরেও শান্তি পাবে না সে। তৃপ্ত হবে না ওর বাবা-মায়ের আত্মা।
ওই দিনের পরের সপ্তাহের শুক্রবারে। জুমার নামাজের আজান পড়েছে ১০-১৫ মিনিটের মতো হয়েছে। শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। রিকশা, মানুষ অন্যান্য যান চলাচলও কম থাকে এ দিন। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। আইল্যান্ড থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে পূবালী ব্যাংকের সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়াল স্বাধীন।
দেখল, এমন সময় একটি সাত-আট বছরের বালকের হাত ধরে শ্মশ্রƒমণ্ডিত এক বৃদ্ধ যাব কি যাব না করতে করতে লাঠি ঠুকঠুকিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। স্বাধীন দেখছে, বৃদ্ধ এক পা নড়েন তো দুই পা পিছিয়ে যান। মুখে বলেছেন, -যাসনে, যাসনে। আস্তে, দাঁড়া। আহ।
ছেলেটি বৃদ্ধকে অভয় দিয়ে যতই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, বৃদ্ধ ততই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যান। এই করতে করতে বৃদ্ধের হাতে ধরা লাঠিটা ছিটকে পড়ে রাস্তায়, আর তা গড়িয়ে এসে ঠোক্কর খায় কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা স্বাধীনের পায়ে। সৌজন্যবশত স্বাধীন লাঠিটা তুলে বুড়ো মানুষটির হাতে দিতেই চোখাচোখি হলো উভয়ের।
ছেলেটি চলে যাচ্ছে বৃদ্ধকে নিয়ে আর স্বাধীনের আশপাশ কেঁপে উঠল ভূমিকম্পে।
বিশ বছর পর! ওর বুকের ভেতর থেকে আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো বুঝি!
-কে আপনি? এই তো সেই লোক! মফিজ মোড়ল।
আমি তোমাকে চিনেছি! চিনেছি! তুমি পালাবে কোথায়?
স্বাধীনের বুকের ভেতরের আলোড়ন কেউ-ই টের পেল না! আর তাকে হারিয়ে যেতে দেবে না সে। মনে মনে বলল, -তুমি যাচ্ছ? যাও। আমি আসছি।
স্বাধীনের বিপন্ন বিস্ময়াহত দুই চোখ গেঁথে রইল তরতর করে চলে যাওয়া বৃদ্ধের ঘাড়ের নিচে।
তিন.
সেদিন বাড়ি ফিরে এসে মফিজ মোড়লের চোখে ঘুম নেই।
কে ওই ছেলেটি? আজ এত বছর পরে, ওই ছেলেটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল কেন? এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না সে।
পরক্ষণেই আবার মনে পড়ে। ফুলতলি গ্রাম। ১৯৭১। হাসান মাস্টারের পালিয়ে যাওয়া ছেলে সে নয় তো? তা কী করে হয়? যদি হয়ই-বা, সে কি তাকে চিনতে পেরেছে?
চেনা কি সম্ভব? সব কিছুই তো বদলে ফেলেছে সে! চেহারা, নিবাস, নাম।
ওর তো অতীত বলে কিছুই নেই। পাড়া-প্রতিবেশীরা কেউই জানে না ওর আসল ঠিকানা।
যে মেয়েটির বাড়িতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন এটিও গ্রাম ছেড়ে চলে আসার পর দ্বিতীয় পক্ষের। তবুও মনটা সায় দেয় না। বুকটা ধুকপুক করে। অন্য দিনের মতো শুতে গিয়েও ঘুম আসে না মফিজ মোড়লের। মনে পড়ে।
কী দোষ ছিল হাসান মাস্টারের?
ছাত্রদের দেশের কথা বলতেন, দেশকে ভালোবাসো, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার মন্ত্র দিতেন। এই তো অপরাধ! কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। একজন সফল শিক্ষক।
এই তার দোষ? না, আরও আছে। সে মোড়ল হওয়া সত্ত্বেও গাঁয়ের লোকজন হাসান মাস্টারের কথাই বেশি মানত। এটা সহ্য হতো না তার। সে জন্যই প্রথম সুযোগে পথের কাঁটা সরিয়ে দিল সে। গাঁয়ের লোক, যারা হাসান মাস্টারকে ভালোবাসত তারা সবাই বলেছে,
-মাস্টার তুমি পালাও।
তিনি হেসে শঙ্কাকে উড়িয়ে দিতেন,
-আরে না, না, কেউই আমার ক্ষতি করবে না, দেখো তোমরা।
কিন্তু ভালো মানুষ মাস্টারের এই বিশ্বাসই তার মৃত্যু ডেকে আনল। মোড়ল ছিল মাস্টারের নিকট প্রতিবেশী।
মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। একদিন সকালবেলা পাক সেনাদের নিয়ে মাস্টারের বাড়ির উঠানে ঢুকেই তার আস্ফালন নিজের চোখেই ভেসে ওঠে ছবির মতোন। গুলি করার আগে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলেছিল,
-হাসান মাস্টার, কলমা পড়, তোমার দিন শেষ। তুমি কলমা পড়।
বিশ বছর আগের এই অন্তিম উচ্চারণ আজ বৃদ্ধের বুকের ভেতর একই তালে নড়তে লাগল। টেবিলের ওপর ঢাকা দেওয়া খাবার পড়ে আছে। মুখে রুচল না। বারবার চোখের ওপর কপাল বরাবর ভেসে উঠল দুটি চোখ।
কে এই যুবক? ওকি চেনা মুখ? হাসান মাস্টারের পালিয়ে যাওয়া সেই ছেলে? মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল মফিজ মোড়লের। কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে! ঘুমভাঙা অনুভূতি কিছুক্ষণ অবশ করে রাখে বৃদ্ধের চেতনা।
আবার দরজায় শব্দ।
কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, -কে?
বৃদ্ধ শুনল, -নানু আমি। দরজা খোল। তোমার দুধ।
একটা ঘোরের মধ্যে বিছানা ছাড়লেন তিনি। ভূতগ্রস্তের মতো দরজা খুললে ঘরে ঢুকল অন্য কেউ। নিশুতি রাত। ঝিঁঝি ছাড়া কেউ জেগে নেই কোথাও!
মফিজ মোড়ল বিহ্বল চোখে সামনের দিকে তাকালেন। বয়স হয়েছে।
প্রথমে বুঝতে পারলেন না। নাতির বদলে আধো অন্ধকার ঘরে একটা ছায়াকে ঢুকতে দেখে কম্পিত কণ্ঠে আবারও জিজ্ঞেস করেন,
-কে তুমি? এত রাতে কী চাও?
কোনো উত্তর না পেয়ে মোড়লের মনে পড়ে গেল দুপুরে দেখা যুবকের চোখ।
কে তুমি? কী চাও?
গলা কেঁপে উঠল কী?
ছায়া কোনো জবাব দিল না দেখে মোড়ল পিছু হটে বিছানার ওপর গিয়ে পড়ল। -কথা বলছ না কেন? কেন এসেছ এত রাতে?
ধীরে ধীরে নীল অন্ধকারমাখা যুবক মোড়লের সামনে এসে দাঁড়াল।
ওপরের দিকে তাকানো বৃদ্ধের চোখের ওপর চোখ রেখে যুবকটি কেবল বলল, -মোড়ল, কলমা পড়। তোমার দিন শেষ।
সেই রাতে আশপাশের অনেকেই শুনেছিল একটি গুলির আওয়াজ।
লেখা পাঠানোর ইমেইল ঠিকানা