বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ হরমুজ প্রণালি। ইরানের উপকূল ঘেঁষা সরু এ চ্যানেল সংযুক্ত করেছে জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ পারস্য উপসাগর ও আরব সাগরকে। শুধু ইরানই নয়, পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন ও ইরানের জ্বালানি তেল রফতানির প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে এ পথের ওপর। ওমান ও ইরানের মধ্যবর্তী গুরুত্বপূর্ণ এ সামুদ্রিক পথ দিয়ে দৈনিক দেড় কোটি ঘনমিটারের মতো এলএনজি পরিবাহিত হয় বলে ইন্টারন্যাশনাল গ্যাস ইউনিয়নের (আইজিইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে, যার সিংহভাগই আসে এ পথে।
কাতার থেকে এলএনজি আমদানির একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালি। প্রতি বছর এ সমুদ্রপথ ধরে অর্ধশতাধিক এলএনজিবাহী কার্গো আসছে দেশে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হরমুজ প্রণালি ইরান দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে এলএনজি আমদানির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বড় শঙ্কা রয়েছে। তাতে প্রভাব পড়বে গ্যাস সরবরাহে। তাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখে দ্রুত এ বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
ইরান ও ইসরায়েলের সংঘর্ষে নতুন করে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি। এর জেরে পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালি দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও জ্বালানি তেল সরবরাহে ব্যাপক ধাক্কা খাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পথটি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা এসেছে তেহরানের পক্ষ থেকে। যদি সত্যিই এ সামুদ্রিক পথ বন্ধ করে দেয়া হয় তবে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি সারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপরই পড়বে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব। বিশ্বজুড়ে নতুন করে বাড়িয়ে তুলতে পারে মূল্যস্ফীতি। এর আঁচ এড়াতে পারবে না বাংলাদেশও। কারণ কাতার থেকে কেবল হরমুজ প্রণালি দিয়েই এলএনজি আমদানি করতে হয়।
কাতারের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১৫ বছর এবং ওমানের প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদে এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। দীর্ঘমেয়াদি এ চুক্তির আওতায় কাতার থেকেই সবচেয়ে বেশি এলএনজি আমদানি করে পেট্রোবাংলা, যা দেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড় ভূমিকা রাখছে।
এলএনজি আমদানির বিষয়টি দেখভাল করে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির সাবসিডিয়ারি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, কাতার গ্যাসের কাছ থেকে চলতি অর্থবছরে মোট ৪০ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত ৩৪ কার্গো দেশে এসেছে। সংশ্লিষ্ট কার্গো আমদানির মাধ্যমে কাতার থেকে ২ হাজার ৯৩ মিলিয়ন টন এলএনজি দেশে এসেছে। বাকি কার্গো আমদানির কার্যক্রম চলমান।
কাতার থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে দেশে এলএনজি আমদানি করছে পেট্রোবাংলা। এ পর্যন্ত জ্বালানি পণ্যটি আমদানি করা হয়েছে মোট ২৬৭ কার্গো। আগামী বছর থেকে কাতারের এলএনজি আরো আমদানির জন্য দ্বিতীয় দফায় চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। ফলে আগামীতে গ্যাস সরবরাহে নির্ভরযোগ্য হিসেবে কাতারকেই বিবেচনা করা হচ্ছে। ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বেশ প্রভাব পড়বে।
জ্বালানি পরিস্থিতির ওপর ইরান-ইসরায়েল সম্ভাব্য সংঘাতের প্রভাবের ব্যাপারে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কাতার থেকে এলএনজি আমদানি কার্যক্রমে আপাতত কোনো সংকট নেই। সরবরাহকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন তারা। পরিস্থিতি খারাপ হলে কাতারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই আমদানিকারকদের অবহিত করা হবে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে হরমুজ প্রণালি দিয়ে জ্বালানি আমদানি ও সরবরাহকারী দেশগুলোর প্রত্যেকের সমস্যা সমান। বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। এলএনজি আমদানি কার্যক্রমে আপাতত কোনো সমস্যা নেই।’
দেশের শিল্প খাতেই এলএনজির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তাই এ জ্বালানির আমদানি সংকটে পড়লে তার প্রভাব পুরো অর্থনীতিতেই পড়বে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘কাতার থেকে এলএনজি হরমুজ প্রণালি দিয়েই আসে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে স্বাভাবিকভাবেই এ রুটে প্রভাব পড়বে। আর যুদ্ধ পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করলে বাই ডিফল্ট রুটটি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ জাহাজ তখন ওই রুট দিয়ে যাওয়ার কথা না। তখন আমাদের এলএনজি নিয়ে ভালোই সমস্যা হবে। অন্যান্য উৎস থেকে সরবরাহ এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু এলএনজি আমদানিতে আমাদের প্রধান উৎস কাতার। এলএনজি কার্গোগুলো অনেক দামি। ফলে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে জাহাজ পরিচালকরা নিজ থেকেই ওই রুটে যাবে না। আর যদিও-বা যায় বীমার প্রিমিয়াম এত বেশি হবে যে এলএনজির দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে।’
যুদ্ধ বাড়লে সরাসরি প্রভাবের পাশাপাশি পরোক্ষ প্রভাবও রয়েছে উল্লেখ করে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘লজিস্টিক ব্যয় তখন বেড়ে যাবে। কারণ জ্বালানির দাম এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ম্যান মেড ফাইবারের ব্যয়ও বেড়ে যাবে। যুদ্ধের প্রভাবে সব ধরনের পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে, দাম বেড়ে যাবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কাস্টমাররা পোশাক কেনা কমিয়ে দেবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে।’
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রচুর জ্বালানি তেল উৎপাদন হয়, যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রফতানি হয়। পারস্য উপসাগর থেকে হরমুজ প্রণালি হয়ে প্রচুর জাহাজ লোহিত সাগরে ঢোকে। সুয়েজ খাল পেরিয়ে যায় ভূমধ্যসাগরে। হরমুজ প্রণালি পেরিয়ে আরব সাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে আসে এলএনজি ও জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) এক প্রতিবেদন অনুসারে, এ পথ দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যের যা প্রায় ২১ শতাংশ।
আরেক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) বলছে, হরমুজ প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত জ্বালানি তেলের প্রায় ৭০ শতাংশেরই ভোক্তা দক্ষিণ এশিয়া। এর মধ্যে রয়েছে চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো। এছাড়া বাংলাদেশ ও শ্রীলংকাও সরাসরি মধ্যপ্রাচ্য থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। ফলে হরমুজ প্রণালিতে যেকোনো ধরনের প্রভাবের প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে এসব দেশের জ্বালানি তেলের বাজারেও।
এলএনজি পরিবহনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ এ প্রণালি। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এলএনজি রফতানিকারক দেশ কাতার ও আরব আমিরাতও তাদের বেশির ভাগ এলএনজি হরমুজ প্রণালি দিয়ে রফতানি করে। জ্বালানি এ পণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই পরিবাহিত হয় এ রুটে। হরমুজ প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত এলএনজির মূল ভোক্তা ইউরোপ।
বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারে এরই মধ্যে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। উভয় দেশে পাল্টাপাল্টি হামলার পর পণ্যটির মূল্য বেড়েছে ১২ শতাংশ পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্যানুসারে, ১২ জুন পর্যন্ত ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৭০ দশমিক ৪ ডলার। একদিনের ব্যবধানে তা ৭৮ দশমিক ৫ ডলারে উঠে গেছে।
এর আগে সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এর চেয়ে বেশি উঠেছিল। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি অপরিশোধিত তেলের দাম পৌঁছয় ৭৯ ডলারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হরমুজ প্রণালিতে দীর্ঘমেয়াদি অবরোধ হলে ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেলের দাম ১০০ থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘এলএনজির দাম বেড়ে যেতে পারে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে সব খাতেই পড়ার কথা। আকাশপথে পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে লিড টাইম বেশি লাগবে।’ সূত্র : বণিক বার্তা