দেশের ৪ হাজার চর কৃষিবিপ্লবের হাতছানি দিচ্ছে। একদা পতিত এবং গো-চারণভূমি চরগুলোতে এখন বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের কৃষকরা। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা চট্টগ্রাম, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার চরাঞ্চলের জমি আবাদযোগ্য করতে নেওয়া হয়েছে ২০৯ কোটি টাকার প্রকল্প। বর্তমানে এসব চরে বছরে প্রায় ২০ ধরনের ফসল উৎপাদন হচ্ছে এবং তা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে, যা চরাঞ্চলের কৃষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও প্রভাব ফেলছে।
নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা জেলার চরাঞ্চলে ব্যাপক হারে আলু, বাদাম ও মিষ্টিকুমড়া চাষ হচ্ছে। একই জমিতে বছরে তিনবার ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে, যা কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
গবেষকদের মতে, এ পদ্ধতি চরাঞ্চলের কৃষিব্যবস্থায় একটি বিপ্লব ঘটাবে এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে ন্যানো ইউরিয়ার মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে খরচ কমে যাচ্ছে এবং উৎপাদনও বাড়ছে। চরাঞ্চলের কৃষকরা এখন শুধু ধান বা সয়াবিনের ওপর নির্ভরশীল নন, বরং বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন। জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় জেগে ওঠা চরের জমি চাষাবাদের উপযোগী করতে ৫ বছরের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০৯ কোটি টাকা। ‘বাংলাদেশের চর এলাকায় আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় ১২১টি উপজেলায় মোট ৩ হাজার ৮৪৬টি চরের মধ্যে প্রথম দফায় ১ হাজার ৪২৭টিকে চাষাবাদ উপযোগী করা হচ্ছে। প্রকল্পটি শেষ হলে চরের শতভাগ জমিকে কৃষি উৎপাদনের জন্য তৈরি করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি ২০-২৫ শতাংশ। এদিকে নদী বা সমুদ্রের নাব্য সংকটের কারণে পলি জমে নতুন করে জেগে উঠেছে প্রায় ৪ হাজার চর। সেগুলোকে চাষাবাদের আওতায় আনতে কাজ শুরু করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণ কৃষিজমির পাশাপাশি নদী বা সমুদ্র উপকূলে জেগে ওঠা নতুন চরগুলোকে আবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। চরের উর্বর জমিতে কৃষি বিপ্লব আনা সম্ভব। আর চাষাবাদ বাড়ানো হবে রবি মৌসুম লক্ষ্য করে। তবে চরের আবাদ একটু ভিন্ন ধরনের। সেজন্য নতুন ফসলের সঙ্গে উচ্চফলনশীল জাতের ফসল আবাদ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এ প্রকল্পে। সেই সঙ্গে চরাঞ্চলের উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হবে উন্নত প্রযুক্তি। চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূল থেকে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত সন্দ্বীপ, হাতিয়া, ভোলাজুড়ে জেগেছে নতুন নতুন ছোট-বড় অনেক চর। এসব অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির চিত্রে ঘটছে অভূতপূর্ব রূপান্তর। বাড়ছে মহিষের বাথান, উর্বর চরে চাষ হচ্ছে ধান ও ডালজাতীয় ফসল। প্রকল্পের আওতায় চরাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের জন্য কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী চরগুলোয় কোনো কৃষক যদি চাষাবাদ করতে আগ্রহী থাকেন তাহলে ওই ব্লকে তার জমি থাকতে হবে। ২৫ বছরের নিচে কোনো কৃষককে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। এ ছাড়া অগ্রাধিকার দেওয়া হবে অভিজ্ঞ কৃষকদের। সেই সঙ্গে চরগুলোয় চাষাবাদ করতে হবে এলাকাভিত্তিক ফসল। ফল, মসলা ও সবজিজাতীয় ফসলের পাশাপাশি চর রক্ষায় সার ব্যবহার এবং বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে কী পরিমাণ সার-বীজ ব্যবহার করা হবে সেগুলোও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের সুনজর ও সহযোগিতা পেলে চরের মাটিতে কৃষিবিপ্লব ঘটানো সম্ভব। চরের ১২ হাজার ৪০২ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হচ্ছে। নদীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোকে কেন্দ্র করে কৃষি বিভাগ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এখানে জোয়ার-ভাটার একটা প্রভাব রয়েছে। তাই ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।