ইতিহাসের গহ্বরে ঢাকা পড়ে গেছে একজন নবীর ইতিহাস। রাজপ্রাসাদে বন্দি হয়েও যিনি হয়ে উঠেছিলেন রাজাদের শিক্ষক। তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ যেন ঈমান, ধৈর্য ও আল্লাহর অদৃশ্য কুদরতের জীবন্ত সাক্ষ্য। তিনি দানিয়েল (আ.)।
তাঁকে সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পর দাফন করা হয়। যখন মুসলিম বাহিনী ইরানের সুস নগরী জয় করে, তখন মুসলিম সেনাপতি আবু মুসা আশআরি (রা.) শহরের একটি দুর্গে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি একটি পর্দা টানানো কক্ষ দেখতে পান। তিনি এ সম্পর্কে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানান, এ কক্ষে নবী দানিয়েল (আ.)-এর দেহাবশেষ সংরক্ষিত রয়েছে।
তাঁর দেহের পাশেই ছিল একটি মুদ্রাভর্তি থলে, যেটি থেকে নির্দিষ্ট সময়ে কিছু অর্থ গ্রহণ করে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হতো। তবে প্রথমে দানিয়েল (আ.)-এর দেহাবশেষ ব্যাবিলন শহরে সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু দুর্ভিক্ষ ও খরার সময় সেখানকার জনগণ তাঁর মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করত। পরে অনুরোধক্রমে তাঁর দেহ সুস শহরে স্থানান্তরিত করা হয়।
এ ঘটনায় আবু মুসা (রা.) আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এ ব্যাপারে খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে সংবাদ পাঠান। খবর পেয়ে উমর (রা.) নির্দেশ দেন—যেন নবীকে সুগন্ধি ও কাফনে শায়িত করে জানাজা পড়ানো হয় এবং অন্য নবীদের মতো যথাযোগ্য সম্মানে দাফন করা হয়। আর পাশে থাকা অর্থ মুসলিম কোষাগারে জমা দেওয়ারও আদেশ দেন তিনি। আবু মুসা (রা.) যথাযথভাবে আদেশ পালন করেন।
তিনি রাতে ১৩টি কবর খনন করেন এবং তার মধ্যে একটি কবরেই গোপনে দানিয়েল (আ.)-কে দাফন করেন। পরে সব কবর একসঙ্গে সমতল করে ফেলা হয়, যাতে কেউ বুঝতে না পারে ঠিক কোন কবরে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যাতে কেউ তাঁর কবর খুঁড়ে ফেলতে না পারে।
মূলত ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন রাজা বুখতেনাসর কিছু লোক বন্দি করে জেরুজালেম থেকে ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন তাদের মধ্যে ছিলেন দানিয়েল (আ.)ও। তারপর একদিন তিনি অদ্ভুত স্বপ্ন পান, কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর তিনি স্বপ্নের বর্ণনা ভুলে যান। রাজা তখন তার রাজ্যের যাজক, জ্যোতিষী ও গণকদের ডেকে পাঠান এবং আদেশ দেন, তারা যেন রাজাকে স্বপ্নটির কথা মনে করিয়ে দেয় এবং তার যথাযথ ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু কেউ তা পারছিল না। রাজা তখন ক্রুদ্ধ হয়ে সবাইকে হত্যার হুমকি দেন এবং তিন দিনের সময়সীমা বেঁধে দেন। এই খবর কারাগারে বন্দি থাকা দানিয়েল (আ.)-এর কানেও পৌঁছে যায়। তিনি বার্তা পাঠান যে তিনি স্বপ্নের প্রকৃত রূপ ও তার ব্যাখ্যা জানেন। তখন রাজা বিস্মিত হয়ে দানিয়েল (আ.)-কে ডেকে পাঠান। দানিয়েল (আ.) রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই তিনি রাজাকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানান। এতে বুখতেনাসর বিস্মিত হয়ে জানতে চান, তিনি সিজদা করতে কেন অস্বীকার করছেন। জবাবে দানিয়েল (আ.) বলেন, ‘আমার প্রভু, যিনি আমাকে জ্ঞান দান করেছেন, তিনি আমাকে তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করতে নিষেধ করেছেন।’
তারপর তিনি তার স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে দেন; ফলে রাজা খুশি হয়ে তাকে সসম্মানে মুক্তি দেন এবং রাজ্যের উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেন। তার মৃত্যুর পর দানিয়েল (আ.) আবার জেরুজালেমে ফিরে যান। পরে তিনি ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের সুস শহরে বসবাস করেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। আবু মুসা আশআরি (রা.) যখন দানিয়েল (আ.)-এর মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা করছিলেন, তখন তিনি তাঁর পাশে একটি বিশেষ আংটি খুঁজে পান। আংটির পাথরে এক বিস্ময়কর দৃশ্য খোদাই করা ছিল—দুটি সিংহ তাদের জিহ্বা দিয়ে এক ব্যক্তিকে স্পর্শ করছে, কিন্তু তাকে কামড়ে ধরছে না বা খাচ্ছে না। আবু মুসা (রা.) এ রহস্যময় খোদাইয়ের অর্থ জানতে চান এবং সেই এলাকার লোকদের কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে তাইলে তাঁরা জানান, দানিয়েল (আ.)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া এক অলৌকিক ঘটনার স্মৃতি ধারণ করতেই এই চিত্রটি আংটিতে খোদাই করা হয়েছিল।
ইতিহাসবিদ ইমাম ইসফাহানি (রহ.) লিখেছেন, দানিয়েল (আ.) ছিলেন এক অসাধারণ জ্ঞানী ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন দাউদ (আ.)-এর বংশধর। যদিও কেউ কেউ তাঁকে নবী হিসেবে মানেন। কারো কারো মতে, তিনি নবী ছিলেন না, বরং একজন সত্যিকারের খোদাভীরু জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন।
(তথ্যসূত্র : আলী আল-হিন্দি, কানজুল উম্মাল, খণ্ড-১২, পৃষ্ঠা-৪৮২; ইবনে কাসির, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০; আহমাদ বালাজুরি, ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা-৩৬৭)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন