সংগীতের ইতিহাস মানব ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। সুপ্রাচীন কাল থেকে সংগীত মানবজীবনের অংশ হিসেবে আছে। সুফি আলেমরা মনে করেন মানবসৃষ্টির আগেই মানবাত্মার ভেতর সুরের দ্যোতনা সৃষ্টি হয়। মহান আল্লাহ রুহের জগতে মানবাত্মার সমাবেশ ঘটান এবং নিজের পরিচয় উন্মোচন করেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাঁর বংশধরকে বের করেন; তাদের নিজেদের সম্পর্কে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন এবং বলেন, আমি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলে, হ্যাঁ অবশ্যই আমরা সাক্ষী থাকলাম।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৭২)
এই সাক্ষাৎ পর্বের মাধ্যমে মানবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়েছে, তা থেকেই যুগে যুগে বিরহ ও প্রেমের আকুতি হয়ে সুর প্রকাশ পেয়েছে। এ জন্য সুফিরা আল্লাহর ভালোবাসায় নিবেদিত সুরের যে সাধনা হয় তার ক্ষেত্রে সংগীত শব্দটি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা এটাকে বলেন, সামা বা সেমা, যা আরবি ‘সিমাউন’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যার অর্থ শোনা বা শোনানো। সুফিরা মনে করেন, সামার প্রেম ও ভক্তিমূলক শব্দ-বাক্য এবং এর হৃদয়হরি সুর অন্তরে আল্লাহর আহবান উপলব্ধিতে সাহায্য করে। শুধু তাই না, এর মাধ্যমে তাঁরা আল্লাহর দরবারে অন্তরে ব্যাকুলতাও পৌঁছে দিতে চান। তাঁরা বিশ্বাস করেন, সামা জাগতিক সুর ও বাদ্যযন্ত্রের অনেক ঊর্ধ্বে। অন্তরের ব্যাকুলতায় সামাকে উচ্চমার্গে পৌঁছে দিতে পারে। এ জন্য তাঁরা বলেন, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসও আল্লাহপ্রেমের সুর হয়ে উঠতে পারে।
সুফিবাদী ধারায় মানুষের নিঃশ্বাস শব্দ ও সামার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা মনে করেন, শ্বাস-প্রশ্বাস হলো মানুষের অন্তর্নিহিত প্রবাহন স্বরতরঙ্গ, যা হৃদস্পন্দন ও নাড়ির স্পন্দনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। সবগুলো পরস্পরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুফিবাদের ভাষায় মানুষ তার সব স্পন্দনের সমন্বয়ে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে উচ্চারণ ‘হু’, যা মহান আল্লাহর সত্তাগত নাম ‘আল্লাহু’-এর প্রতিনিধিত্ব করে।
মানুষের কাজ হলো তার ভেতরে চলমান এই সুর তরঙ্গের ব্যাপারে নিজের চেতনাকে জাগ্রত করা এবং আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে তাতে প্রাণ সৃষ্টি করা। এ জন্য সুফিবাদী কবি নিয়াজ-ই-মিসরি বলেন, ‘শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া পৃথিবীতে একটি অক্ষরও জীবন্ত হয় না।’ সুফি ও কবি তাওফিক নিজামি বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে থাকা সব কিছু অন্ধকার শেষে আলোর মতো।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনা বলেন, আলোর সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাসের মিল আছে, কিন্তু অন্ধকারের সঙ্গে নেই। এটাই একমাত্র বিষয়, যা মানব-রসায়ণকে পরমাত্মার নৈকট্য দান করে। মানুষ নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় ‘লা ইলাহা’ এবং ত্যাগের সময় ‘ইল্লাল্লাহু’ বলে। এ জন্য সুফিবাদী সংগীতের শিক্ষকরা শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাঁরা বলেন, মানুষ যতক্ষণ নিজের অন্তর্নিহিত স্বর ও সুর শুনতে পারবে না, ততক্ষণ কণ্ঠের সুর স্বর্গীয় স্বাদ লাভ করবে না।
সুফি সাধকরা বলেন, অনন্ত ও অনাদি কাল থেকে মহান আল্লাহ একক সত্তা হিসেবে বিদ্যমান ছিলেন। অতঃপর তিনি ‘কুন’ (হও) শব্দ উচ্চারণ করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় আরবি বর্ণ কাফ ও নুন দ্বারা গঠিত এই শব্দের ধ্বনিই হয়ে ওঠে সব সৃষ্টির উপলক্ষ। তাই সৃষ্টি মাত্রই তার ভেতরে এই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়। যখন বান্দা আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসায় নিজেকে নিয়োজিত করে, তখন সে তার ভেতরে এটাকে হৃদস্পন্দনের মতো প্রতিধ্বনিত হতে শোনে। ধীরে ধীরে তাতে ঐশ্বরিক স্বাদ যুক্ত, হাদিসে যাকে ঈমানের স্বাদ বলা হয়েছে। বান্দা যখন উপেক্ষা ও উদাসীনতায় মত্ত থাকে, তখন এই ধ্বনি সে আর শুনতে পায় না। যেমন বহু ধ্বনি ইথারে হারিয়ে যায় মানুষের অগোচরে। তার জীবন কাটে বিতৃষ্ণা, হতাশা ও চরম অস্থিরতায়।
চমত্কৃত হওয়ার মতো একটি বিষয় হলো পৃথিবীতে মানুষের আগমন হয় আল্লাহর নামে উচ্চারিত আজানের ধ্বনি শুনে এবং মৃত্যুর পর (জানাজার নামাজে) আল্লাহর বড়ত্বের তাকবির ধ্বনি শুনে তাঁর বিদায়। যদিও আজান ও তাকবিরকে সংগীত বলা যায় না, তবু এটা তো ঠিক যে এখানেও স্বর (উচ্চারণ) ও সুরের (মদ বা দীর্ঘস্বর) মাত্রা ঠিক রাখতে হয় শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনেই।
প্রাজ্ঞ আলেমরা মনে করেন, সংগীতের সুফিবাদী ধারাকে নিঃশর্তভাবে অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই। এসব গানের মূলকথা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা নিবেদন হলেও তা নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকবে। কেননা সুর ও সংগীত এমন স্রোতস্বিনী নদীর মতো, যা মানুষ বিপজ্জনক স্থানে নিয়ে যেতে পারে। তাঁরা বলেন, শর্ত সাপেক্ষে সামা বা ভক্তিমূলক সংগীত গাওয়া বা শোনা জায়েজ আছে। এর প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে তা শিরক, কুফর ও অশ্লীল বাক্য থেকে মুক্ত থাকবে। এবং তাতে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। আল্লামা আশরাফ আলী থানবি (রহ.) বলেন, সুলতান নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) ‘ফাওয়াইদুল ফুয়াদ’ নামক গ্রন্থে ‘সামা’ (ভক্তিমূলক সংগীত) বৈধ হওয়ার শর্তগুলো উল্লেখ করেছেন। যার মূলকথা হলো সামার চার স্তম্ভের সঙ্গে চারটি শর্ত সম্পৃক্ত। চার স্তম্ভ হলো—১. শ্রোতা, ২. যে ব্যক্তি শোনায়, ৩. যা শোনা হয়, ৪. যেসব যন্ত্রের মাধ্যমে শোনা হয়।
এই চার স্তম্ভ সম্পর্কে খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) লেখেন—
১. শ্রোতা : শ্রোতাকে পবিত্র মনের অধিকারী হতে হবে। সে যেন প্রবৃত্তির পূজারি না হয়। যে ব্যক্তি সামা শুনবে সে অবশ্যই পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী হবে। সে এমন প্রবৃত্তির পূজারি হবে না যে প্রবৃত্তির পেছনে পেছনে ছোটে।
২. যে শোনায় : যে ব্যক্তি সামা শোনাবে সে অবশ্যই পুরুষ হবে। নারী বা অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক হতে পারবে না। সামা পরিবেশনকারী প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ না হয়ে নারী বা অপ্রাপ্তবয়স্ক দাড়িহীন বালক হলে তা শোনা জায়েজ হবে না।
৩. যা শোনা হয় : যে পদ্য, কবিতা বা সংগীত শোনা হবে তা অর্থহীন ও অশ্লীল হতে পারবে না। ভক্তিমূলক সংগীতে শিরক, কুফরি, অন্যের সমালোচনা, অহমিকা, প্রহসনমূলক কৌতুক বা অশ্লীলতা থাকতে পারবে না।
৪. যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয় : সামার সঙ্গে দোতারা, সেতারা, হারমোনিয়াম বা অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
আল্লামা আশরাফ আলী থানবি (রহ.) উল্লিখিত শর্তগুলো বর্ণনা করার পর বলেন, পূর্ববর্তী কোনো সুফি সাধকের ব্যাপারে সামা শ্রবণের কথা প্রমাণিত। বুজুর্গদের মধ্যে যাঁরা সামা শ্রবণ করতেন তাঁরা উল্লিখিত শর্তসহই শ্রবণ করতেন।
আল্লাহ সবাইকে সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমিন।
তথ্যঋণ : ডেইলি সাবাহ, মিনহাজ ডটঅর্গ ও মাজালিসে হাকিমুল উম্মত
বিডি প্রতিদিন/নাজিম