হজ এমন সুমহান ইবাদত, যা মানবজাতিকে ভালোবাসার অভিন্ন সুতায় বেঁধে রাখে। হজ মানুষের ভেতর আল্লাহপ্রেমের এমন অনুপ্রেরণা ও আত্মত্যাগের উৎসাহ সৃষ্টি করে, যা বিশ্বের নানা জাতি, শ্রেণি, বর্ণ ও অঞ্চলের মানুষের ভেতর পার্থক্য মুছে দেয়। ফলে তারা এক কাতারে সমবেত হয়। হজযাত্রীদের চির শুভ্র কাফেলায় ধনী-দরিদ্র, শাসক-প্রজা, গুনাহগার ও আল্লাহর ওলিদের ভেতরে কোনো পার্থক্য থাকে না।
তারা একই পোশাকে, একই ময়দানে, একই উপত্যকায় এবং একই ঘরের চারদিকে বিচরণ করে। হজের সফরে তারা পরস্পর সহ্য ও সম্মান করতে শেখে, পরস্পরের সাহায্য-সহযোগিতায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে শেখে, ক্ষমা ও বিনয়ের চর্চা হয় সর্বত্র। তাদের ভেতর এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে আল্লাহপ্রেমের তাড়না থেকে।
কেননা মহানবী (সা.) তাকে শিখিয়েছেন, ‘অন্যকে ক্ষমা করার কারণে আল্লাহ বান্দার মর্যাদা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি করেন এবং যে আল্লাহর জন্য বিনীত হয় আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৮)।
কোনো এক কবি বলেছেন-
আল্লাহপ্রেমে বিলীন হওয়ায়
টিকে থাকার রাজ
যে জানে না মরতে
বেঁচে থেকে নেই তার কাজ।
আল্লাহর প্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ওপরই নির্ভর করে মানবসভ্যতার অস্তিত্ব। এ জন্য আল্লাহ প্রতিবছর তাঁর ঘরে সমবেত করেন তাঁর প্রেমিক বান্দাদের। যেন এই সমাবেশের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টিজগতের সুগভীর সম্পর্কের বার্তা মানবসমাজে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে, যারা গাফেল ও বিমুখ তাদের স্মরণে আসে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘পবিত্র কাবাঘর, পবিত্র মাস, কোরবানির জন্য কাবায় প্রেরিত পশু ও গলায় মালা পরিচিত পশুকে আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারিত করেছেন। এটা এ জন্য যে তোমরা যেন জানতে পারো, যা কিছু আসমান ও জমিনে আছে আল্লাহ তা জানেন এবং আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।’(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৯৭)।
তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো মক্কায়, তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারি।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬)
আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্য প্রথম থেকে এই বরকতময় ঘর নির্মাণ করেছেন। কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায়, ভূপৃষ্ঠ সৃষ্টির পর সর্বপ্রথম মক্কা অঞ্চল দৃশ্যমান হয়।
পৃথিবীতে মানবজাতিকে পাঠানোর আগে ফেরেশতারা কাবাঘর নির্মাণ করেন। আল্লাহ তাআলা আদম (আ.) থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসুলকে হজ ও কাবাঘর তাওয়াফের নির্দেশ দেন। কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্র এই ঘর মানুষের আধ্যাত্মিক পাথেয় অর্জনের মাধ্যম। এখানেই রাখা হয়েছে তাদের অন্তরের প্রশান্তি ও স্বস্তি।
ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং সেই সময়কে স্মরণ করো, যখন কাবাঘরকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম।’(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১২৫)।
আল্লাহ তাঁর পবিত্র ঘরের প্রতি এমন আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন যে বছরজুড়ে সারা পৃথিবীর মানুষ সেখানে সমবেত হয়, বিশেষত হজের সময় আল্লাহর নির্বাচিত বান্দারা সেখানে উপস্থিত হয়। তাদের উসিলায় আল্লাহ উম্মতের জন্য ক্ষমার ফয়সালা করেন এবং আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এই ঘর থেকে বান্দা আল্লাহর স্মরণ ও ভালোবাসার দীক্ষা নিয়ে ফেরে। ফলে তারা আল্লাহর জন্য তাঁর সৃষ্টিজগতের প্রতি দয়াশীল হয় এবং আল্লাহ বিধান মেনে জীবনযাপন করে।
এভাবে দুনিয়ায় ন্যায়, ইনসাফ, মানবতার শিক্ষা ও আলো ছড়িয়ে পড়ে। যেদিন মানুষ এই ঘরের আলো থেকে বঞ্চিত হবে, সেদিন তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠবে। এ জন্য হাদিসে বায়তুল্লাহ বিরান হওয়াকে কিয়ামতের শেষ নিদর্শন বলা হয়েছে।
প্রতিবছর প্রেম ও ভালোবাসায় পাগলপাড়াদের সম্মিলন ঘটে কাবাঘরের পবিত্র চত্বরে। এখানে যেমন অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের মাধ্যম তাদেরকে এক সুতায় গাঁথে, তেমনি হজের এই মহিমান্বিত ও বিশ্বব্যাপী সম্মেলনের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে প্রেম, আত্মবিসর্জন ও ত্যাগের শিক্ষা দেওয়া হয়। যেমন হজযাত্রী মহান আল্লাহর প্রেমে আত্মবিলীন হয়ে যায় এবং হজের প্রতিটি ধাপে পরস্পরের জন্য ত্যাগ ও সহানুভূতির অনুভব জাগ্রত হয়, তেমনিভাবে যদি সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সর্বদা আল্লাহর পরম প্রেমে নিমগ্ন হয়ে আত্মবিসর্জন দেয়, অন্তরে সব সময় একে অপরের জন্য ত্যাগ ও সহানুভূতির স্পন্দন জাগ্রত রাখে, অন্যদের প্রতি নম্র আচরণ করে, সমাজের বিভিন্ন স্তরকে সঙ্গে নিয়ে চলার কৌশল অর্জন করে, সঙ্গীদের মতামত শুনে-বুঝে প্রয়োজন হলে তা গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে পারস্পরিক বিবাদ ও সমস্যাগুলো দূর হবে, জীবনের পথ সুগম হবে, জাগতিক উন্নয়নও সাধিত হবে এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষও লাভ হবে। কতই চমৎকার হতো, যদি বিশ্ব মুসলিম হজের ইবাদত থেকে এই শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা গ্রহণ করত এবং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনকে এই নীতিমালার ভিত্তিতে গড়ে তুলত।
মহানবী (সা.) আরাফার ময়দানে যে দোয়া করেছিলেন তাতেও মানবজাতির প্রতি হজের সুমহান বার্তা স্পষ্ট হয়। তিনি দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কথা শুনছ, তুমি আমার অবস্থান দেখছ, তুমি জানো আমার অন্তরের গোপন বিষয় ও প্রকাশ্য বিষয়, আমার ব্যাপারে কিছুই তোমার নিকট গোপন নয়। আমি হতভাগা, দরিদ্র, সাহায্য প্রার্থী, আশ্রয় প্রার্থী, আতঙ্কিত, দুঃখিত, আমার গুনাহ স্বীকারকারী ও দোষারোপকারী। আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি, যেমন এক অভাবী বান্দা প্রার্থনা করে। আমি তোমার কাছে মিনতি করি, যেমন একজন পাপী, লাঞ্ছিত বান্দা মিনতি করে। আমি তোমার কাছে দোয়া করি, যেমন ভীত, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি দোয়া করে। আমি দোয়া করি সেই ব্যক্তির মতো, যার ঘাড় তোমার সামনে নত হয়ে গেছে, যার চোখে অশ্রু প্রবাহিত, যার দেহ তোমার সামনে বিনম্র, যার নাক তোমার সামনে মাটি স্পর্শ করছে। হে আল্লাহ! তুমি যেন আমার এই দোয়া ব্যর্থ বা হতভাগা কোরো না। তুমি আমার প্রতি করুণা ও দয়া করো, হে সর্বোত্তম যাঁর কাছে প্রার্থনা করা হয়, আর তুমিই সর্বোত্তম দাতা!
আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ