দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষের বাসস্থান গাজা উপত্যকায় সাত সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে সব মানবিক সাহায্যের প্রবেশে ইসরায়েলের বাধা অব্যাহত থাকায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) শুক্রবার জানিয়েছে, খাদ্য শেষ হয়ে গেছে।
শুক্রবার ডব্লিউএফপি ঘোষণা করেছে, তারা তাদের অবশিষ্ট সরবরাহ রান্নাঘরে পৌঁছে দিয়েছে যেখানে গরম খাবার তৈরি করা হচ্ছে, যা কয়েক দিনের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের সংস্থাটি সতর্ক করে দিয়েছে, জরুরি ব্যবস্থা না নিলে পরিবারগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা বন্ধ করতে বাধ্য হতে পারে।
এতে বলা হয়েছে, ‘গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি আবারও এক ভাঙন পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার উপায় হারিয়ে ফেলছে এবং সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতির সময় অর্জিত ভঙ্গুর সাফল্যগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে।’
গাজায় কয়েক সপ্তাহ ধরে খাদ্য সহায়তার একমাত্র ধারাবাহিক উৎস ছিল রান্নাঘর, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবনরেখার প্রতিনিধিত্ব করে, যদিও তারা তাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার মাত্র এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।
ডব্লিউএফপি ২৫টি বেকারিকেও সহায়তা করেছিল, যেগুলো ৩১ মার্চ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ, গমের আটা এবং রান্নার জ্বালানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া পরিবারগুলোতে বিতরণ করা খাদ্য প্যাকেজ যার মধ্যে দুই সপ্তাহের রেশন ছিল সেই সপ্তাহেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সাত সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে গাজায় কোনো মানবিক বা বাণিজ্যিক সরবরাহ প্রবেশ করেনি। কারণ, সব প্রধান সীমান্ত পয়েন্ট বন্ধ রয়েছে।
জাতিসংঘের সংস্থা এবং মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার মানবিক সহায়তার জন্য আবেদন করেছেন।
ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, গাজায় এই বন্ধের ঘটনাটি সবচেয়ে দীর্ঘতম এবং এটি ইতোমধ্যেই ভঙ্গুর বাজার এবং খাদ্য ব্যবস্থাকে আরও খারাপ করে তুলছে।
বছরের শুরুতে যুদ্ধবিরতি সময়ের তুলনায় খাদ্যের দাম ১,৪০০ শতাংশ আকাশচুম্বী হয়েছে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে।
এটি অপুষ্টির বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে বিশেষ করে ছোট শিশু, গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মহিলা, বয়স্ক ব্যক্তি এবং অন্যান্য দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য।
ইতোমধ্যে ১১৬,০০০ মেট্রিক টনেরও বেশি খাদ্যসহায়তা যা চার মাস পর্যন্ত ১০ লাখ মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত আছে। সীমান্ত পুনরায় খোলার সঙ্গে সঙ্গে ডব্লিউএফপি এবং অংশীদারদের দ্বারা গাজায় আনার জন্য অপেক্ষা করছে।
সংস্থাটি বলেছে, ‘ডব্লিউএফপি সব পক্ষকে বেসামরিক নাগরিকদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এবং অবিলম্বে গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে তাদের বাধ্যবাধকতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলি আক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
শুক্রবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস গাজা এবং পশ্চিম তীর উভয়েরই অবনতিশীল পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, গত ১৮ মাসে গাজার ২২ লাখ ফিলিস্তিনির জীবন যুদ্ধবিগ্রহ, মানবিক সহায়তার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ এবং প্রায় সব প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ধ্বংসের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
‘যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে বিশেষ করে গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি আক্রমণ ত্বরান্বিত হয়েছে। যার ফলে অসংখ্য বেসামরিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে এবং অবশিষ্ট অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।’
স্থানচ্যুতি আদেশ এবং ‘গাজা উপত্যকায় ইসরাইলিদের পুনর্নবীকরণ সম্পূর্ণ অবরোধ’ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘খাদ্য এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের অভাবের কারণে জনসংখ্যা ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠছে, সামাজিক অস্থিরতা আরও গভীর হচ্ছে, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের ঘন ঘন খবর পাওয়া যাচ্ছে ।’
এটি এমন একটি পরিবেশে বিরাজ করছে যেখানে ইসরায়েলি আক্রমণ এবং স্থানীয় প্রশাসনের বেসামরিক কর্মকর্তাদের টার্গেট করার মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার ব্যবস্থা পদ্ধতিগতভাবে ভেঙে পড়েছে।
গাজার বেসামরিক নাগরিকদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সেই অবকাঠামোগুলোকেও টার্গেট করে চলেছে।’
২১ থেকে ২২ এপ্রিলের মধ্যে তিনটি গভর্নরেটে ইচ্ছাকৃত এবং সমন্বিত আক্রমণের ফলে মানবিক ত্রাণ কার্যক্রমে ব্যবহৃত ৩৬টি ভারী মেশিন যেমন খননকারী, পানির ট্রাক এবং নর্দমা সাকশন ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়ে যায়।
‘এগুলো ধ্বংস করার ফলে উদ্ধারকাজ উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আহত ও নিহতদের উদ্ধার, অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের জন্য ধ্বংসাবশেষ অপসারণ, সেইসঙ্গে নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহ, কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা পরিচালনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এতে রোগের প্রাদুর্ভাবের আরও ঝুঁকি তৈরি করবে।’
আশ্রয় কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে। ১৮ মার্চ থেকে ২২ এপ্রিলের মধ্যে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখে ওএইচসিএইচআর-এর অফিস আবাসিক ভবনে ২২৯টি আক্রমণ এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের তাঁবুতে ৯১টি আক্রমণ রেকর্ড করেছে। বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়েছে শিশু এবং মহিলার।
অফিসটি বলেছে, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে, পার্থক্য, আনুপাতিকতা এবং সতর্কতার মূল নীতি লঙ্ঘন করে গাজাজুড়ে বেসামরিক নাগরিক এবং বেসামরিক বস্তুর ওপর ক্রমাগত ইসরায়েলি সামরিক আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ‘১৮ মাস ধরে অত্যন্ত উচ্চ বেসামরিক হতাহতের ফলে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তু করার পদ্ধতি এবং নীতিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না। যা অন্তত গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ অবহেলার ইঙ্গিত দেয়।’
‘ইসরায়েলের গাজা উপত্যকায় ইচ্ছাকৃতভাবে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রবেশে বাধা দেওয়ার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এই নীতিগুলো গাজার বেসামরিক জনগণকে শাস্তি দেওয়ার এবং তাদের ওপর এমন জীবনযাত্রার পরিস্থিতি চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে যা গাজায় তাদের অব্যাহত অস্তিত্বের সঙ্গে ক্রমবর্ধমানভাবে অসঙ্গত।’
ইতোমধ্যে পশ্চিম তীরে, ‘ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত বসতি স্থাপনকারীদের ব্যাপক সহিংসতা এবং অভিযান’ অনেক এলাকায় ফিলিস্তিনিদের হত্যা বা আহত করছে অথবা তাদের বাড়িঘর বা আশ্রয়স্থল থেকে জোর করে বের করে দিচ্ছে।
২৩ এপ্রিল একটি ঘটনায় রামাল্লাহর একটি গ্রামে বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের এবং তাদের সম্পত্তির ওপর আক্রমণ করে বলে জানা গেছে। আটজন তরুণ ফিলিস্তিনি পুরুষ আহত হন এবং তিনটি কৃষি কাঠামো ধ্বংস করা হয়। পশ্চিম তীরের অন্যান্য স্থানে অন্যান্য ‘উদ্বেগজনক ঘটনা’ রেকর্ড করা হয়েছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী পশ্চিম তীরে ১৯২ জন শিশুকে হত্যা করেছে- যেদিন হামাস এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি হামাস গোষ্ঠী ইসরায়েলের ওপর মারাত্মক আক্রমণ শুরু করেছিল।
অধিকন্তু উত্তর পশ্চিম তীরে বৃহৎ আকারের ইসরায়েলি অভিযান এখন তৃতীয় মাসে প্রবেশ করেছে। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী জেনিন এবং তুলকারেম শরণার্থী শিবিরে ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে ফিরে যেতে বাধা দিচ্ছে।
বিবৃতিতে সতর্ক করা হয়েছে, ‘প্রতিদিন এই অভিযান অব্যাহত থাকার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত শিবিরগুলোতে থাকা ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। যার ফলে পশ্চিম তীরের গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যা জোরপূর্বক স্থানান্তরের সমান।’