ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ থাকায় মানবিক সংকট তীব্র হয়েছে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায়। মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক কার্যালয় (ওসিএইচএ) সতর্ক করে বলেছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে উপত্যকাটিতে মানবিক সংকট সবচেয়ে জটিল পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা আনাদোলু।
এতে বলা হয়, গাজায় টানা ৫০ দিন ধরে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ। ওসিএইচএর মুখপাত্র জেন্স লার্কে বলেছেন, গাজা বর্তমানে সম্ভবত সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। জেনেভায় জাতিসংঘের ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি। গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ভয়াবহ পরিস্থিতির ওপর জোর দিয়েছেন জেন্স লার্কে। বলেছেন, পরিস্থিতি যে বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২ মার্চ থেকে গাজার ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। এ ছাড়া ত্রাণ ও সব প্রকার সহায়তা উপকরণও পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে তারা। উপত্যকাটিতে মানবিক বিপর্যয় চলছে জেনেও নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে তেল আবিব। উল্লেখ্য, যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে ১৮ মার্চ থেকে গাজায় পুনরায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫১ হাজার ২০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে তারা। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নভেম্বরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩২ : গাজায় মঙ্গলবার ভোর থেকে দিনভর ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৩২ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১১ জন খান ইউনিস শহরের একটি ঘরে বিস্ফোরণে সৃষ্ট আগুনে পুড়ে মারা যান। এর পাশাপাশি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া লাশ উদ্ধারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিও ধ্বংস করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজা শহরের পশ্চিমাঞ্চলে এক পরিবারের সাত সদস্য নিহত হন বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার সময় ইসরায়েলি বিমান হামলায়। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, রাতের দিকে গাজা সিটির আল-তুফফাহ এলাকায় আল-দুররা শিশু হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী। হাসপাতালের সৌর প্যানেলেও বিমান হামলা চালানো হয় বলে টেলিগ্রামে জানায় তারা।
পোলিও টিকা ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে প্রতিনিয়ত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। ১৮ মাস ধরে চালানো এ আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৫১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল গাজাতে সর্বাত্মক অবরোধও জারি রেখেছে। এর ফলে গাজায় বহু মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছেন। আর এবার ইসরায়েলের বাধায় গাজায় পোলিও টিকা প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে গাজার ৬ লাখেরও বেশি শিশু। মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা আনাদোলু।
বার্তা সংস্থাটি বলছে, ইসরায়েল পোলিও টিকা গাজায় প্রবেশ করতে না দেওয়ায় ৬ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি শিশু ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানায়, ‘টিকা ঢুকতে না দেওয়ার কারণে পোলিও প্রতিরোধে শুরু হওয়া চতুর্থ পর্যায়ের ক্যাম্পেইন বন্ধ হয়ে গেছে।’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ‘টিকা সরবরাহ অব্যাহত না থাকলে ৬ লাখ ২ হাজারের বেশি শিশু আজীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়তে পারে।’ মন্ত্রণালয় আরও জানায়, গাজার শিশুদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বর্তমানে নজিরবিহীন ও ভয়াবহ। কারণ সেখানে যথাযথ পুষ্টি ও নিরাপদ খাবার পানির পুরোপুরি অভাব রয়েছে। আনাদোলু বলছে, ২০২৪ সালের আগস্টে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১০ মাস বয়সি এক শিশুর শরীরে পোলিও শনাক্ত করে, যা ছিল ওই অঞ্চলে প্রথম পোলিও সংক্রমণের ঘটনা। এরপর থেকেই ইসরায়েলের গাজা আগ্রাসনের মধ্যেই টিকাদান কার্যক্রম চালানো হয়। তিনটি ধাপে এ টিকাদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রথম ধাপে ৫ লাখ ৬০ হাজারের বেশি শিশু টিকা পায়। দ্বিতীয় ধাপে ১০ বছরের নিচের ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৭৭৪ শিশু এবং তৃতীয় ধাপে আরও ৫ লাখ ৯০ হাজার শিশুকে টিকাদান করা হয়। জাতিসংঘ বলছে, পূর্ণ সুরক্ষার জন্য গাজার শিশুদের অন্তত দুটি মৌখিক পোলিও টিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আনাদোলু
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সাহায্য সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘গাজা পরিণত হয়েছে এক মরুভূমিতে।’ তিনি জানান, সেখানে আটকে আছে প্রায় ৩ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক, যেগুলোতে খাদ্য ও ওষুধ রয়েছে, কিন্তু ইসরায়েলের বাধায় তা গাজার ভিতরে ঢুকতে পারছে না। গাজায় মানবিক সাহায্য আটকে রাখাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছেন জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদনকারী ফ্রানচেস্কা আলবানিজে। ‘এর মাধ্যমে গাজাবাসীদের জীবনযাপন আরও দুর্বিষহ করে তাদের ধ্বংসের পথ তৈরি করা হচ্ছে,’ বলেছেন তিনি। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ২ মার্চ থেকে চলা অবরোধে গাজা এক নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এতে খাবার, পানি, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকায় প্রতিদিন হামলা চলছে। এর সবকিছু ইসরায়েলি নেতৃত্বের ‘পূর্বপরিকল্পিত অপরাধ’ বলে অভিযোগ করেছে সংগঠনটি। -রয়টার্স ও আনাদোলু