দক্ষিণ ইউরোপজুড়ে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের পাশাপাশি দাবানল পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে গ্রিস, স্পেন, তুরস্ক ও আলবেনিয়ায়। গেল ২৪ ঘণ্টায় গ্রিসে নতুন করে ১৫২টির বেশি স্থানে দাবানলের সূত্রপাত হয়েছে। দাবানল নিয়ন্ত্রণে গ্রিসজুড়ে অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের চার হাজার ৮৫০ সদস্য কাজ করছেন। কয়েক হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দাবানলে স্পেন, আলবেনিয়া ও তুরস্কে অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট ও দগ্ধ হয়ে অগ্নিনির্বাপণকর্মীসহ আরও অনেককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে ইউরোপের কয়েকটি অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। ফ্রান্স ও স্লোভেনিয়ায় রেকর্ড তাপপ্রবাহ হয়েছে। গ্রিসের পর্যটন দ্বীপ কিয়স ও জাকিনথোস থেকে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
পশ্চিম পেলোপনিসে আগুন রাতারাতি পাত্রাস শহরে ঢুকে ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও যানবাহন ধ্বংস করেছে। জান্তে দ্বীপে ১৫ কিলোমিটারজুড়ে (৯ মাইল) বিস্তৃত তিনটি পৃথক দাবানল এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। এতে বসতবাড়ি, পর্যটন অবকাঠামো ও কৃষিজমির ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
আজ বুধবার গ্রিসের ফায়ার সার্ভিসের মুখপাত্র ভাসিলিস ভাথ্রাকোগিয়ানিস বলেন, অগ্নিনির্বাপণ দলের অন্তত ১৫ সদস্য দগ্ধ ও অন্যান্য আঘাতের চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, আগামী কয়েক দিনে পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে।
ভাথ্রাকোগিয়ানিস বলেন, ‘আজকের দিনটি খুবই কঠিন যাবে। কারণ, দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে দাবানলের উচ্চ ঝুঁকি রয়ে গেছে।’
কিয়স দ্বীপে দাবানলে আটকে পড়া সমুদ্রসৈকতের পর্যটকদের নৌকায় করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দাবানল নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অন্যান্য দেশ থেকে অগ্নিনির্বাপণ বিমান চাওয়া হয়েছে।
স্পেনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় লিওন প্রদেশে স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ৪ হাজারের বেশি মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। একই এলাকায় একজন স্বেচ্ছাসেবক অগ্নিনির্বাপণ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।
মাদ্রিদের কাছে ত্রেস কান্তোসে এলাকায় মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে এক অশ্বক্রীড়া কেন্দ্রের কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সেখানে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার (৪৩ মাইল) বেগে বাতাস বইছে। এতে করে আগুন বসতবাড়ির দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে শত শত মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে।
স্পেনের সরকার জাতীয় জরুরি কার্যক্রমের মাত্রা বাড়িয়েছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, ‘আমরা বনাঞ্চলে দাবানলের চরম ঝুঁকিতে আছি। দয়া করে সবাই খুব সতর্ক থাকুন।’
আলবেনিয়ায় দাবানলের কারণে গত সোমবার অনেক মানুষকে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে হয়েছে। ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, বলকান অঞ্চলসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশেও তাপপ্রবাহ ও দাবানল নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু এলাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ফারেনহাইট) ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
গতকাল দিবাগত রাতে স্লোভেনিয়ায় রেকর্ড তাপমাত্রা অনুভূত হয়েছে। দেশটির একটি সমুদ্রবন্দরে রাতভর তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামেনি।
সোমবার ইতালিতে হিটস্ট্রোকে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে দেশটির তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। রোম, মিলান, ফ্লোরেন্সসহ অন্তত ১০টি শহরে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ইতালির দ্বীপ সার্ডিনিয়ায় একটি গাড়ির ভেতরে চার বছর বয়সী রোমানিয়ার এক শিশুকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া গেছে। হেলিকপ্টারে করে শিশুটিকে রোমের হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হিটস্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্ক গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিশুটির মৃত্যু হয়েছে।
ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ক্যাথেরিন ভত্রিন বলেছেন, কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে আমাদের দেশে দ্বিতীয় তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ মন্টেনেগ্রোর রাজধানী পডগরিকার উত্তরের পাহাড়ি এলাকায় দাবানল নেভানোর সময় একটি পানিবাহী ট্যাংকার উল্টে পড়ে এক সেনাসদস্য নিহত ও আরেকজন গুরুতর আহত হয়েছেন। পর্তুগালে অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা এখনো তিনটি বড় দাবানলের সঙ্গে লড়ছেন। এর মধ্যে দেশটির মধ্যাঞ্চলের ত্রানকোসো এলাকার দাবানলটি সবচেয়ে বড়।
তুরস্কের চানাক্কালে, ইজমিরসহ কয়েকটি স্থানের কিছু বড় দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। নিয়ন্ত্রণে আনার আগে কয়েক শ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দার্দানেলস প্রণালি ও চানাক্কালে বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের কিছু এলাকায় চলতি বছর চতুর্থবারের মতো তাপপ্রবাহ চলছে। কোনো কোনো এলাকায় তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। পুরো ইংল্যান্ডে দাবদাহজনিত উচ্চ (অ্যাম্বার) ও মৃদু থেকে মাঝারি (ইয়েলো) স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
গতকাল লন্ডনের দুটি স্থানে দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। একটি ইলিংয়ে এবং আরেকটি ওয়ানস্টেড ফ্ল্যাটসে। এই দুই ঘটনায় মোট ১৭ একরের বেশি এলাকা পুড়ে গেছে।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের গ্রীষ্ম আরও বেশি গরম ও শুষ্ক হয়ে উঠছে, যা দাবানল মৌসুমকে দীর্ঘতর ও তীব্রতর করার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজিম