গাজার আকাশে উড়ন্ত ইসরায়েলি বিমানগুলো যেমন দ্রুত প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, তেমনি এক নীরব ও ধীরগতির অস্ত্র, অর্থাৎ দুর্ভিক্ষ, কেড়ে নিচ্ছে শত শত জীবন। ইসরায়েলের পরিকল্পিত অবরোধের কারণে এখন পর্যন্ত ২১২ জনের অনাহারে মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯৮ জনই শিশু। এটি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় বরং একটি সুচিন্তিত নীতির নির্মম পরিণতি।
গত ৯ অক্টোবর ২০২৩-এ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গাজায় একটি সম্পূর্ণ অবরোধ ঘোষণা করেন, যা খাদ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি—সবকিছু বন্ধ করে দেয়। তৎকালীন জ্বালানিমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ মানবিক সহায়তাকে “চাপ প্রয়োগের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার” হিসেবে বর্ণনা করেন। এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপের ফলে ২৩ লাখ মানুষকে খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ, গাজা এখন এমন এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে যা ইতিহাসে বিরল।
আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি ‘বিপর্যয়কর’ পরিস্থিতিতে জীবন যাপন করছেন, যা গণমৃত্যুর ঠিক আগের ধাপ। ইউনিসেফের তথ্যমতে, গাজা শহরে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টির হার গত দুই মাসে চার গুণ বেড়ে ১৬.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। শুধু জুলাই মাসেই ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে অপুষ্টিতে, যার মধ্যে ২৪ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইন স্পষ্টভাবে বেসামরিক মানুষকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অনাহারে রাখা নিষিদ্ধ করেছে। জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল ৫৪ এবং রোম স্ট্যাটিউটের আর্টিকেল ৮ অনুযায়ী এটি একটি যুদ্ধাপরাধ। এমনকি মে মাসে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে, যার অন্যতম অভিযোগ ছিল বেসামরিক নাগরিকদের অনাহারে রাখা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়েসাস এই পরিস্থিতিকে “মানব সৃষ্ট গণ-দুর্ভিক্ষ” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সারা বিশ্বে বিক্ষোভকারীরা “দুর্ভিক্ষ একটি যুদ্ধাপরাধ” স্লোগান দিয়ে গাজার অবরোধ অবসানের দাবি জানাচ্ছেন। অনেক দেশ এই অবরোধের নিন্দা করলেও, তাদের বেশিরভাগই শুধু কথায় সীমাবদ্ধ। তবে কিছু দেশ ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করেছে। ইরান তাদের সামরিক পদক্ষেপকে গাজার সুরক্ষার সঙ্গে যুক্ত করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এই অবরোধকে “নজিরবিহীন অমানবিকতা” বলে অভিহিত করে দ্রুত ত্রাণ করিডোর খোলার দাবি জানিয়েছে।
গাজার এই দুর্ভিক্ষ এখনও চলছে। এটি এমন একটি অপরাধ, যা আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। যদি বিশ্ব এই মুহূর্তে দৃঢ় পদক্ষেপ না নেয়, তবে মানবতা তার নৈতিক নেতৃত্বের দাবি হারাবে। ইতিহাস মনে রাখবে, কারা এই অপরাধ দেখেও নীরব ছিল, এবং কারা সবচেয়ে ধীরগতির অস্ত্রটিকে তার কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিল। গাজার শিশুদের এই নীরব কান্না কি বিশ্ববাসীর বিবেককে জাগ্রত করবে?
সূত্র: মেহের নিউজ
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল