গাজার দক্ষিণে খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল হাসপাতালে জুলাইয়ের ২৫ তারিখ মাত্র নয় মাস বয়সী ইয়ারার নিঃশব্দ প্রস্থান ঘটে। না, কোনো বোমা বা গুলিতে নয়— ইয়ারা মারা যায় ক্ষুধায়। তাঁর মা ফিসফিস করে বলেন, ও যুদ্ধের মাঝে জন্মেছিল, যুদ্ধেই মারা গেল। কিন্তু ওর মৃত্যু হলো ক্ষুধায়।
ইয়ারা ছিল চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। তার মা নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি। সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় থেকেই অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। যুদ্ধের ভয়াবহতায় ভিটেমাটি হারিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছিলেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে, কেনার মতো দুধ নেই। যেটুকু খাবার মেলে, সেটুকু যায় বড় ছেলেমেয়েদের মুখে। ইয়ারার মা বলেন, ওকে খাওয়াতে পারিনি, কারণ আমি নিজেই খেতে পারিনি।
গাজার স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, এই অনাহার কেবল দুর্ঘটনা নয় এটি পরিকল্পিত। তারা বলছে, গোটা গাজার জনগোষ্ঠী এখন অপুষ্টিতে ভুগছে, যার মধ্যে ১১ লাখ শিশু রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন গড়পড়তা মাত্র ৭০-৮০টি সাহায্যবাহী ট্রাক ঢুকছে গাজায়, যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। তার ওপর এই সাহায্যও হামলার শিকার হচ্ছে, লুট হচ্ছে, অথবা ইসরায়েলি নজরদারির কারণে পৌঁছাতেই পারছে না।
ইসরায়েলি বাহিনী এমনকি খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষদের ওপরও হামলা চালাচ্ছে, অভিযোগ গাজার মিডিয়া অফিসের। “এটি একটি ইঞ্জিনিয়ারড ফ্যামিন,” বিবৃতিতে বলা হয়। “তারা গাজার সমাজকে ভিতর থেকে ভেঙে দেওয়ার জন্য ক্ষুধা তৈরি করছে।”
দেইর আল বালাহর আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের পাঁচ মাস বয়সী নূরহান আয়াদ আর কাঁদতেও পারে না। তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ নিঃশ্বাসে রূপ নিয়েছে। তার মা মোনা আবু মারুফ বলেন, আমার দুধ শুকিয়ে গেছে। ও বেঁচে আছে শুধু স্যালাইনের ওপর। আমি কিছুই দিতে পারি না।
ইসরায়েলের হামলায় হাজার হাজার পুরুষ মারা গেছেন খাবারের খোঁজে বেরিয়ে। মোহাম্মদ মেহান্না তেমন একজন। স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন, আমাদের কিছু নেই, আমাকে যেতেই হবে। কিন্তু ফিরে আসেননি, এসেছেন খণ্ডবিখণ্ড দেহ হয়ে।
এক সময় কৃষক ছিলেন হামেদ হাসান। আজ ৭০ বছরের এই বৃদ্ধ একটি ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন স্ত্রী, কন্যা ও নাতনিদের সঙ্গে। হৃদরোগের ওষুধ খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার না থাকায় তিনি এখন স্যালাইনেই বেঁচে আছেন।
ড. বাসসাম জাকুত জানান, শিশুরা এমন হারে মারা যাচ্ছে যা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি। আমাদের কাছে না আছে দুধ, না আছে খাবার, না আছে ওষুধ।
তিনি আরও বলেন, এটা চতুর্থ বা পঞ্চম ধাপের অপুষ্টি — যার পরিণতি শুধুই মৃত্যু।
বেইত হানুনের বিধবা মা সুহাদ এল হেলু কাঁপা গলায় বলেন, সেদিন মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম নারী-নির্ধারিত সাহায্য কেন্দ্রে। ভিড়ের চাপে এক মহিলা পদদলিত হয়ে মারা যান। আমি মেয়েকে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছি। খালি হাতে ফিরেছি, চোখে পানি নিয়ে।
এই প্রতিটি গল্প, প্রতিটি চোখের জল, প্রতিটি শুকনো মুখ আমাদের মনে করিয়ে দেয়— ক্ষুধা এখানে অস্ত্র হয়ে উঠেছে। একেকটি মৃত্যু যেন একেকটি চিহ্ন, মানবতার ব্যর্থতার প্রমাণ।
এখানে মানুষ আর বেঁচে নেই, প্রতিদিন একটু একটু করে মারা যাচ্ছে।
গাজার এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, আমরা প্রতিদিন লেন্টিল রান্না করি, তাও পর্যাপ্ত নয়। কেউ কেউ আমাদের সামনে মারা যায়, অথচ আমাদের হাতে কিছু নেই।
অনাহার, সহানুভূতি, আন্তর্জাতিক মানবতা— সবই এখন শব্দ মাত্র। গাজায় আজও অপেক্ষা চলছে সেই সাহায্যের, যা হয়তো আর কখনো আসবে না। শেষ কথায় সুহাদ বলেন, তারা আমাদের ক্ষুধায় মারছে। এটা দুর্ঘটনা নয়। এটা পরিকল্পনা।
সূত্র: টিআরটি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল