নতুন প্রকৃতির এক ড্রোন আবিষ্কার করেছে চীন। যেটি পাল্টে দিতে পারে বিশ্বজুড়ে আকাশযুদ্ধের হিসাব-নিকাশ। অত্যানুধিক এই ড্রোনের নাম ‘জিউ তিয়ান’।
চীনা সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চীনা এই ড্রোন প্রযুক্তি অত্যানুধিক, যার পেটের মধ্যে লুকোনো থাকবে শ’খানেক আত্মঘাতী অস্ত্র। মৌমাছির মতো ঝাঁক বেঁধে আক্রমণ শানাবে এটি। আকাশ-রণকৌশল বদলাতে চীনা বিমানবাহিনী খুব শিগগিরই এই নতুন অস্ত্র হাতে পেতে যাচ্ছে।
মা যেমন তার সন্তানকে গর্ভে আশ্রয় দেয়, তেমনই চীনা প্রযুক্তিতে তৈরি এই বিশালাকার ড্রোনটিও বহন করবে ১০০টি খুনি ড্রোন। মানববিহীন ছোট ছোট ড্রোনগুলোর প্রতীকী নাম দেওয়া হয়েছে ‘সোয়ার্ম ড্রোন’।
শত্রুদেশের ওপর একযোগে ড্রোন হামলা চালাতে চীনের সামরিক অস্ত্রাগারে একটি যুগান্তকারী সংযোজন হতে চলেছে এই যুদ্ধযানটি। ড্রোনগুলো বহন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘ড্রোন ক্যারিয়ার’।
‘জিউ তিয়ান’ নামের এই দীর্ঘপাল্লার মানববিহীন বিশেষ আকাশযানটি (ইউএভি) আনুষ্ঠানিকভাবে জুনের শেষ দিকে প্রথম অভিযানের জন্য যাত্রা করবে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, এটি বেইজিংয়ের একটি সাহসী পদক্ষেপ। আগামী দিনে মানববিহীন আকাশযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কুপোকাত করতে চীন গোটা বিশ্বকে টেক্কা দিল।
চীনের সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, জিউ তিয়ানই হতে চলেছে বিশ্বের প্রথম আকাশযান, যা একক অভিযানে শত শত স্বয়ংক্রিয় ড্রোন নিক্ষেপ করতে পারবে। কামিকাজে ইউএভি-সহ ১০০টি ছোট ড্রোন বা ছোট যুদ্ধাস্ত্র বহন করতে পারে জিউ তিয়ান। মনুষ্যবিহীন ‘ড্রোন মাদারশিপ’টি পিপল্স লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং এর লক্ষ্য আকাশযুদ্ধে ক্ষমতা বিস্তারের ভিত্তি স্থাপন করা।
সাত হাজার কিলোমিটার পাল্লা এবং উন্নত স্কোয়াড-লঞ্চিং প্রযুক্তি সম্পন্ন এই ‘ড্রোন মাদারশিপ’টি ১৫ হাজার মিটার উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। এর ডানার বিস্তার ২৫ মিটার। সর্বোচ্চ ১৬ টন ওজনের যুদ্ধাস্ত্র বহন করার ক্ষমতা রাখে এই যানটি। বিমানটি উচ্চগতির এবং বেশ কিছু মাঝারি পাল্লার আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে চলতে পারে।
চীনের সরকারি মালিকানাধীন ‘অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন অব চায়না’র (এভিআইসি) তত্ত্বাবধানে এই আকাশযানটির নকশা যৌথভাবে তৈরি করেছে শানসি আনম্যানড ইকুইপমেন্ট টেকনোলজি এবং গুয়াংজু হাইজ কমিউনিকেশনস। ‘জিউ তিয়ানে’ রয়েছে ক্যামেরা এবং অত্যাধুনিক সেন্সর, যা আশপাশের এলাকা চিহ্নিত করতে ড্রোনগুলোকে সাহায্য করে। সামুদ্রিক এলাকায় নজরদারি, সীমান্ত টহল এবং দুর্যোগের আভাস পেলেও তা শনাক্ত করতে পারে বিমানটি।
এই ভারী ওজনের ইউএভি ক্যারিয়ারটি চীনের উন্নত ড্রোন প্রযুক্তির ভান্ডারে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এটি ‘স্টেল্থ কমব্যাট’ ড্রোন ও মাঝারি উচ্চতায় উড়তে সক্ষম অ্যান্টি-সাবমেরিন ড্রোন ‘উইং লুং এক্স’-এর মতো অত্যাধুনিক ড্রোনের পাশে জায়গা দখল চীনা বাহিনীতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অনেক সমরাস্ত্র বিশ্লেষক মনে করছেন, এই ড্রোন ক্যারিয়ারটি যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারকারী দু’টি নজরদারি ড্রোন আর কিউ গ্লোবাল হক ও এম কিউ ৯ রিপারের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে। মাঝ-আকাশে একাধিক ড্রোন উৎক্ষেপণ এবং মাদারশিপকে ‘কমান্ড সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষমতাসম্পন্ন বিমান তৈরি করা চীনের বহু দিনের স্বপ্ন ছিল।
প্রতিটি ছোট ড্রোন একে অপরের সঙ্গে ও মাদারশিপের সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদান করতে সক্ষম। সোজা বাংলায় মা ও তাদের সন্তানেরা একে অপরের সঙ্গে ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি করে নেয়। এতে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে, যার মাধ্যমে এটি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে ড্রোন নিক্ষেপ করতে পারে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র ১৮ মাসে চারটি পরীক্ষামূলক সংস্করণ (প্রোটোটাইপ) তৈরি করা হয়েছে। ‘জিউ তিয়ান’-এর একটি উঁচু প্রধান ডানা রয়েছে, যার ডগায় ছোট ছোট ডানা বসানো আছে। পাশাপাশি একটি এইচ আকৃতির লেজও রয়েছে। বিমানটি একক জেট ইঞ্জিন দ্বারা চালিত এবং এতে তিন চাকার ল্যান্ডিং গিয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হোক বা পশ্চিম এশিয়ায় ইসরায়েলের সঙ্গে হামাস-হিজবুল্লার লড়াই— কোনও জায়গাতেই চীনা ড্রোন ব্যবহার হয়নি। অন্যদিকে ইরান, তুরস্ক, আমেরিকা, রাশিয়া এবং ইসরায়েলের মানববিহীন ড্রোনগুলো সংঘর্ষের মোড় ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এগুলোর কোনওটার গায়ে বাঁধা বিস্ফোরক, কোনওটার কাজ আবার শুধুই গুপ্তচরবৃত্তি। তবে এ রকম শত শত ড্রোন পাঠিয়ে শত্রুপক্ষকে নাজেহাল করাই উদ্দেশ্য চীনের। তাদের লক্ষ্য, শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করে দেওয়া। মূলত ঝাঁক বেঁধে হামলা চালানোয় সিদ্ধহস্ত সোয়ার্ম ড্রোন পরিচালিত হয় কৃত্রিম মেধার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) দ্বারা।
একসঙ্গে উড়লেও তাদের একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধার কোনও আশঙ্কা নেই। যেকোনও পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে এই সোয়ার্ম ড্রোন। ছোট-বড় মিলিয়ে বিভিন্ন আকারের মানববিহীন ড্রোন থাকতে পারে। সোয়ার্ম ড্রোনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, ঝাঁকের মধ্যে এগুলোর বেশ কয়েকটিকে ধ্বংস করলেও বাকিগুলো ঠিকই কাজ করতে থাকে।
একসঙ্গে শত শত ড্রোন পাঠানো হলে শত্রুর বিস্তৃত এলাকার ওপর নজরদারি সহজ হয়। কিছু ড্রোন আবার জ্যামার হিসেবে কাজ করে শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়।
একের পর এক অত্যাধুনিক হাতিয়ারকে সামনে রেখে গোটা দুনিয়াকে চমকে দিচ্ছে চীন। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হল ড্রোনবহনকারী আকাশযানটি। নয়া প্রযুক্তি দেখে ভুরু কুঁচকে উঠছে আমেরিকা-সহ পশ্চিমা দেশুগুলোর।
মূলত দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান প্রণালী ও ভারত-চীন সীমান্ত এলাকায় নজরদারি চালানোর স্বার্থেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। তাইওয়ানের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে এই নতুন প্রযুক্তি ওই অঞ্চলে সামরিক ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। চীন-তাইওয়ান ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে আগামী দিনে বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে এই আকাশযান, মনে করছেন অনেকেই।
অস্ত্র প্রতিযোগিতায় আমেরিকাকে পিছনে ফেলতে নতুন যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পঞ্চম প্রজন্মের স্টেল্থ যুদ্ধবিমান, ষষ্ঠ প্রজন্মের বোমারু বিমান তৈরি করছে চীন। গুয়াংডং প্রদেশে চলা ‘ঝুহাই এয়ার শো’য়ে এই সব আধুনিক সমরাস্ত্রের ঝলক দেখেছে বিশ্ববাসী। যা দেখে কপালে ভাঁজ পড়েছে ওয়াশিংটন-সহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর। বেইজিং পরপর নতুন হাতিয়ার নিয়ে আসায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, সিএনবিসিটিভি১৮
বিডি প্রতিদিন/একেএ